বরিশাল বিভাগের তিন জেলার ৫৫ গ্রামে পেয়ারার ফলন প্রতি বছরই ভালো হয়। বরিশাল, ঝালকাঠি এবং পিরোজপুর জেলার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন।
আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালপাড়ে পেয়ারার সমারোহ থাকলেও বৈরি আবহাওয়া এবং করোনাভাইরাসের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাবে ভালো নেই পেয়ারা চাষিরা। ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভীমরুলীর ভাসমান হাট থেকে বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারা সরবরাহ হয় সারা দেশে।
কিন্ত মহামারি করোনা, কম ফলন ও এনথ্রাক্স (ছিটপড়া) রোগের কারণে পেয়ারার ভরা মৌসুমেও বড় লোকসানের মুখে পড়েছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।
আষাঢ়ের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় পেয়ারার মৌসুম। প্রতি বছর মৌসুমজুড়ে প্রতিদিন নৌকা, ট্রলার ও ট্রাকে করে পেয়ারা যেত দেশের বিভিন্ন স্থানে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চাষি, বাগান মালিক, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কোলাহলে মুখর থাকত ভীমরুলী ভাসমান হাটসহ প্রতিটি পেয়ারা বাগান। কিন্ত এখনকার চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনার কারণে ও ফলন কম হওয়ায় পাইকারদের আনাগোনা অর্ধেকেরও কম।
এদিকে পেয়ারা বাগানকে ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন কার্যক্রমও নিষ্প্রাণ। ফলে পেয়ারাকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নেমেছে। লোকসানে চরম বিপর্যয়ের মুখে চোখে মুখে অন্ধকার দেখছেন কয়েক হাজার কৃষক। পেয়ারার রাজ্য খ্যাত ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠী, জগদীশপুর এলাকা ঘুরে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
কাপুড়কাঠি গ্রামের প্রবীণ পেয়ারা চাষি মোক্তার হোসেন জানান, ভীমরুলীকে পেয়ারার রাজ্য বলা হলেও পার্শ্ববর্তী বরিশালের বানারীপাড়া, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি এবং ঝালকাঠি সদর উপজেলার ৫৫গ্রাম জুড়ে পেয়ারা চাষের বিস্তৃতি রয়েছে। এ তিন উপজেলার ৫৫ গ্রামে যুগ যুগ ধরে চাষ হচ্ছে বাংলার আপেল খ্যাত পেয়ারা।
কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বরিশাল বিভাগের অন্যত্র পেয়ারা হলেও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি জেলার ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বরিশাল জেলার বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠি জেলায় ৭৫০ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষ হয় ১৩ গ্রামের ৩৫০ হেক্টর জমিতে, স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়।
এসব এলাকার মধ্যে ঝালকাঠির কীর্তিপাশা, ভিমরুলী, শতদশকাঠি, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়কাঠি, জগদীশপুর, মীরাকাঠি, শাখাগাছির, হিমানন্দকাঠি, আদাকাঠি, রামপুর, শিমুলেশ্বর এই গ্রামে বৃহৎ অংশজুড়ে বাণিজ্যিকভাবে যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ হয়।
স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের মধ্যে রয়েছে সঙ্গীতকাঠি, খায়েরকাঠি, ভদ্রানন্দ, বাচ্চুকাঠি, ভাংগুরা, আদাবাড়ি, রাজাপুর, ব্রাহ্মণকাঠি, ধলহার, জিন্দাকাঠি, আটঘর, কুড়িয়ানা, পূর্ব জলাবাড়ি, ইদিলকাঠি, আরামকাঠি, মাদ্রা, গণপতিকাঠি, আতাকাঠি, জামুয়া, জৈলশার, সোহাগদল, আদমকাঠি, অশ্বত্থকাঠি, সমীত, সেহাংগল, আন্দারকুল।
বরিশালের বানারীপাড়ার পেয়ারা বাগানগুলো হলো তেতলা, সৈয়দকাঠি, মালিকান্দা, ব্রাহ্মণবাড়ি, বোয়ালিয়া, জম্বুদ্বীপ, বিশারকান্দি, মরিচবুনিয়া, মুরার বাড়ি, উমরের পাড়, লবণ সড়া, ইন্দির হাওলা, নরেরকাঠি, রাজ্জাকপুর, হলতা, চুয়ারিপাড়। এসব গ্রামের কয়েক হাজার কর্মজীবী পরিবার যুগ যুগ ধরে পেয়ারার চাষ করছে।
পেয়ারার চাষ, ব্যবসা ও বাজারজাতকরণেও রয়েছে কয়েক হাজার মৌসুমি বেপারি এবং শ্রমিক। এ সময় অন্তত কুড়িটি স্থানে পেয়ারার মৌসুমি মোকামের সৃষ্টি হয়। এগুলো হলো ভিমরুলী, আতাকাঠী, ডুমুরিয়া, গণপতিকাঠী, শতদশকাঠী, রাজাপুর, মাদ্রা, আদমকাঠী, জিন্দাকাঠী, বর্ণপতিকাঠী, আটঘর, কুড়িয়ানা, আন্দাকুল, রায়ের হাট, ব্রাহ্মণকাঠী, ধলহার, বাউকাঠী।
মোকামের মৌসুমে প্রতিদিন ৫-৭ হাজার মন পেয়ারা কেনাবেচা হতো। কিন্তু ফলন কম ও করোনার প্রভাবে এবার চাষিদের মনে আনন্দ নেই। কারণ এসব এলাকার মানুষের আয়ের অন্যতম উৎস্য হচ্ছে পেয়ারা। ছিটপড়া রোগের কারণে চাষিরা এবার দামও পাচ্ছেন না।
পেয়ারা চাষি নিশিথ হালদার শানু বলেন, ‘এ বছর বাগানে তেমন ফলন হয়নি। তার ওপর করোনার ভয়ে চাষিরা বাগানের যথাযথ পরিচর্যা করতে না পারায় ‘ছিটপড়া’ রোগে আক্রান্ত হয়েছে প্রতিটি বাগান। যে কারণে প্রতি মণ পেয়ারা বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়। অথচ এর আগে প্রতি মণ পেয়ারা পাইকারি বিক্রি হয়েছে ৮০০-১০০০ টাকায়।’
পেয়ারা চাষি সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহর মণ্ডল বলেন, ‘গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর পেয়ারার ফলন ৪০ ভাগ কম হয়েছে। রোগবালাইও বেশি। যার প্রভাব পড়েছে বাজারমূল্যে। ফলন কম হওয়ায় শত শত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন।’
এ বিষয়ে কির্ত্তিপাশা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আ. রহিম মিয়া বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফলন কম হয়েছে। আর করোনার প্রভাবে চাষিরাও বাগানের যত্ন নিতে পারেননি। এছাড়াও পাইকারদের পরিবহন সমস্যা হওয়ায় তাদের আনাগোনাও অনেক কম। তাই এবার পেয়ারা চাষিদের মুখে হাসি নেই। চাষিরা এখন চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন।’
এদিকে করোনার কারণে উপজেলা প্রশাসন পেয়ারা বাগান ঘিরে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলোতে দর্শনার্থীদের আগমন নিষিদ্ধ করায় নিষ্প্রাণ হয়ে আছে। প্রতি বছর হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমনের কারণে স্থানীয় ট্রলার চালক ও ভাড়ার মোটরসাইকেল চালকরা প্রতিদিন ভালো আয় করতো। বিশেষ কিছু দর্শনীয় স্থানের হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে প্রচুর অতিথি আসত। তাদের খানাপিনায় অর্থনৈতিকভাবেও স্বচ্ছল হতো ব্যবসায়ীরা। কিন্তু এ বছর তাদের কোনো আয় নেই।
ঝালকাঠি জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ফজলুল হক জানান, ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ও আম্ফানের কারণে পেয়ারার উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। আর করোনার প্রভাবে চাষিরা যথাযথভাবে পরিচর্যা করতে না পারায় ছিটপড়া রোগের বিস্তার ঘটেছে। এ কারণে ফলন এ বছর কম হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এ বছর পেয়ারা চাষিরা যাতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেন সেজন্য তাদের বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ (বীজ, সার, কীটনাশক) সহযোগিতা ও সহজ শর্তে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে। তবে বিশেষ কোনো প্রণোদনা দেয়ার উদ্যোগ নেয়নি সরকার। সরকারিভাবে বিশেষ প্রণোদনা এলে পেয়ারা চাষিদের তা যথাযথভাবেই দেয়া হবে।’
এমএসএম/এমআরএম/জিকেএস