দুনিয়ার সব কিছুই নিয়ম মেনে চলে। তবে এর কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সৃষ্টি জগতের সবকিছুরই ধ্বংস হবে। সব প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। শুধু মহান আল্লাহ ছাড়া কোনো কিছুরই অস্তিত্ব থাকবে না। এ জন্যই এ প্রবাদটি সবার মুখে মুখে- ‘জন্মিলে মরিতে হইবে, অমর কে কোথা ভবে’। কোরআনুল কারিমের ঘোষণায় এমনটিই প্রমাণিত-
كُلُّ مَنْ عَلَیْهَا فَانٍ، وَّ یَبْقٰی وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلٰلِ وَ الْاِكْرَامِ
ভূপৃষ্টের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া।’ (সুরা আর-রাহমান : আয়াত ২৬-২৭)
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে ঘোষণা করেন-
كُلُّ نَفْسٍ ذَآىِٕقَةُ الْمَوْتِ
‘প্রত্যেক প্রাণই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৮৫)
মৃত্যু অনিবার্য। মানুষসহ সব প্রাণীই মারা যাবে। দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র জীবনে নানা জনের সঙ্গে নানানভাবে গড়ে ওঠা বন্ধনও ছিন্ন করে দেবে মৃত্যু। পরিবার-পরিজন, বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীসহ আরও কত আপনজনই থেকে যাবে। কেউ আগে কিংবা কেউ পরে। কিন্তু যাত্রা সবার জন্যই সুনিশ্চিত। তবে মানুষ ও জ্বীন জাতির হিসাব হবে। তাই মৃত্যুপথ যাত্রীর মৃত্যুকালীন সময় থেকে পরবর্তী সময়ে জীবিতদের কিছু করণীয় রয়েছে। কী সেই সব করণীয়?
মৃত্যুর মুহূর্তে আপনজনের করণীয়
দুনিয়া পরকালের শস্যক্ষেত্র। আর মৃত্যুকালীন সময়ে যে অবস্থার উপর মানুষ মৃত্যুবরণ করবে তার ফলাফলও সে অনুযায়ী হবে। হাদিসে পাকে এসেছে-
إِنّمَا الأَعْمَالُ بِالْخَوَاتِيمِ
‘আমল তো শেষ অবস্থা অনুসারেই বিবেচিত হবে।’ (বুখারি)
সুতরাং এ সময়টিতে জীবিতদের করণীয় হলো জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কালেমা তালকিন দেওয়া। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
لَقِّنُوا مَوْتَاكُمْ لَا إِلَهَ إِلّا اللهُ
তোমরা তোমাদের মৃত্যুগামী ব্যক্তিদের- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র তালকীন দাও।’ (মুসলিম)
কারণ মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে একটু উচ্চ আওয়াজে কালেমা তালকিন দেওয়া উত্তম। তার পাশে যখন কালেমা পড়া হবে, তিনি যখন কালেমার আওয়াজ শুনতে পাবেন; আশা করা যায় তিনি নিজেই কালেমা পড়ে নিতে পারবেন। যার জীবনের শেষ কথা হবে এ কালেমা। তার জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
مَنْ كَانَ آخِرُ كَلاَمِهِ لاَ إِلَهَ إِلاّ اللهُ دَخَلَ الْجَنّةَ
‘যার শেষ কথা হবে- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (আবু দাউদ)
মুমূর্ষু ব্যক্তির পাশে বসে সুরা ইয়াসিন তেলাওয়াত করার কথাও এসেছে হাদিসে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
اقْرَءُوا (يس) عَلَى مَوْتَاكُمْ
‘তোমরা মৃত্যুপথযাত্রীর পাশে থেকে সুরা ইয়াসিন পাঠ করো।’ (আবু দাউদ, হা ইবনে হিব্বান)
মৃত্যুর পর আপনজনদের করণীয়
নির্ধারিত সময়ে সবাইকে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হবে। কেউ নির্ধারিত সময়েল বেশি বাঁচতে পারবে না। মহান রব এভাবে ঘোষণা দেন-
اِذَا جَآءَ اَجَلُهُمْ لَا یَسْتَاْخِرُوْنَ سَاعَةً وَّ لَا یَسْتَقْدِمُوْنَ
‘এরপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহূর্তও বিলম্বিত কিংবা তরাম্বিত করতে পারবে না।’ (সুরা নহল : আয়াত ৬১)
প্রত্যেক ব্যক্তির জন্যই মৃত্যুর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে। তারপর থেকে জীবিতরাই গোসল, জানাজা, দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করবে। মৃত্যু পরবর্তী সময়ে তাদের জন্য মাগফেরাত ও কল্যাণ কামনা করবে।
১. গোসল-জানাজা-দাফন
মৃত ব্যক্তিকে সুন্দরভাবে গোসল দিতে হবে। তার জানাজার নামাজ আদায় করে তাকে দাফন করা। এগুলো জীবিত আপনজনদের করতে হয়। মাটি থেকেই মানুষের সৃষ্টি, দুনিয়ার জীবন শেষ করে মাটিতেই হয় মৃতব্যক্তির শেষ গন্তব্য। আল্লাহ তাআলা বলেন-
مِنْهَا خَلَقْنٰكُمْ وَ فِیْهَا نُعِیْدُكُمْ وَ مِنْهَا نُخْرِجُكُمْ تَارَةً اُخْرٰی
‘আমি তোমাদেরকে তা (অর্থাৎ মাটি) থেকেই সৃষ্টি করেছি, তাতেই আবার তোমাদের আমি ফিরিয়ে নেব এবং তা থেকেই পুনরায় তোমাদের জীবিত করব।’ (সুরা ত্বহা : আয়াত ৫৫)
২. দাফনে দেরি না করা
অনেক সময় নানা কারণে মৃত ব্যক্তিকে দাফন করতে দেরি হয়। কখনো দূর-দূরান্তের আপনজনদের অপেক্ষায়, কখনো অধিক মুসল্লির অংশগ্রহণে জানাজার নামাজ আদায় করার জন্যে, কখনো এক এলাকা থেকে মৃতদেহ অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনে দাফন দেরি হয়। দুনিয়ার এ জীবনের নানান কারণে এটি হয়ে থাকে। কিন্তু ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা হলো- কেউ যখন মারা যায়, তখন দ্রুতই যেন তাকে দাফন করা হয়। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
أَسْرِعُوا بِالْجِنَازَةِ فَإِنْ تَكُ صَالِحَةً فَخَيْرٌ تُقَدِّمُونَهَا إِلَيْهِ وَإِنْ يَكُ سِوَى ذَلِكَ فَشَرّ تَضَعُونَهُ عَنْ رِقَابِكُمْ
‘তোমরা মৃতব্যক্তির জানাজা-দাফন ইত্যাদি দ্রুত করো। সে যদি নেককার মানুষ হয়ে থাকে তবে তো তার জন্যে কল্যাণ ও পুরস্কার রয়েছে, তোমরা তাকে সেই কল্যাণের দিকেই এগিয়ে দিলে। আর যদি সে এমন না হয়, তবে (দাফনের মধ্য দিয়ে) তোমরা তোমাদের ঘাড় থেকে এ মন্দকে নামিয়ে দেবে।’ (বুখারি)
অন্য হাদিসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজরত আলি রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বলেন-
يَا عَلِيّ! ثَلاَثٌ لاَ تُؤَخِّرْهَا: الصّلاَةُ إِذَا أَتَتْ، وَالجَنَازَةُ إِذَا حَضَرَتْ، وَالأَيِّمُ إِذَا وَجَدْتَ لَهَا كُفْئًا
‘আলি! তিনটি জিনিস বিলম্বিত করো না- নামাজ, যখন এর সময় হয়ে যায়; জানাজার নামাজ এবং উপযুক্ত পাত্র পাওয়া গেলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া।’ (তিরমিজি)
সুতরাং দাফন সম্পর্কে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, মৃত ব্যক্তি যেমনই হোক, নেককার হোক কিংবা না হোক, দ্রুত দাফনের মধ্যেই রয়েছে কল্যাণ, হয়তো তার জন্য, কিংবা জীবিতদের জন্য।
৩. জানাজা দেওয়া
জানাজার নামাজ যদিও ফরজে কেফায়া, কিছু মানুষ পড়লেই সবার পক্ষ থেকে দায়িত্ব আদায় হয়ে যায়, কিন্তু জানাজার নামাজ মূলত একটি দোয়া। মৃতব্যক্তির জন্যে জীবিতদের দোয়া এবং তা এক মুসলমানের কাছে আরেক মুসলমানের হকও বটে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
حَقّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ خَمْسٌ رَدّ السّلاَمِ وَعِيَادَةُ الْمَرِيضِ وَاتِّبَاعُ الْجَنَائِزِ وَإِجَابَةُ الدّعْوَةِ وَتَشْمِيتُ الْعَاطِسِ
‘মুসলমানের ওপর মুসলমানের হক পাঁচটি- সালাম দিলে উত্তর দেওয়া, অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া, জানাজা ও দাফনে শরিক হওয়া, দাওয়াত করলে তা গ্রহণ করা এবং হাঁচি দিয়ে কেউ আলহামদুলিল্লাহ বললে তার উত্তরে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা।’ (বুখারি)
জানাজার পর দাফন পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং দাফন সম্পন্ন করা। এতে রয়েছে অনেক ফজিলত। হাদিসে এসেছে-
مَنْ شَهِدَ الْجَنَازَةَ حَتّى يُصَلِّيَ عَلَيْهَا فَلَهُ قِيرَاطٌ، وَمَنْ شَهِدَ حَتّى تُدْفَنَ كَانَ لَهُ قِيرَاطَانِ قِيلَ وَمَا الْقِيرَاطَانِ قَالَ مِثْلُ الْجَبَلَيْنِ الْعَظِيمَيْنِ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মৃতব্যক্তির জানাজার নামাজে যে শরিক হয় তার জন্য রয়েছে এক কিরাত (সাওয়াব)। আর যে তাকে দাফন করা পর্যন্ত থাকে, তার জন্য রয়েছে দুই কিরাত (সাওয়াব)। কেউ একজন প্রশ্ন করল- দুই কিরাত কী? তিনি তখন বললেন, দুটি বড় (ওহুদ) পাহাড়ের সমতুল্য।’ (বুখারি)
৪. দাফনপরবর্তী সময়ে দোয়া-ইসতেগফার করা
জানাজার নামাজই মৃতব্যক্তির জন্যে একটি দোয়া। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এই এক দোয়াই শেষ নয়। দাফনের পরপরই শুরু হয় তার কবরজগতের প্রশ্নোত্তর পর্ব। পরকালের প্রথম মনজিল এ কবর। পরীক্ষার শুরু এখানেই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একবার একজনকে দাফন করার পর সেখানে দাঁড়িয়ে বললেন-
اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا لَهُ التّثْبِيتَ فَإِنّهُ الآنَ يُسْأَلُ
‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ইসতেগফার করো এবং তার জন্য প্রার্থনা করো- সে যেন সত্যের ওপর অবিচল থাকতে পারে। এখন তো তাকে প্রশ্ন করা হবে।’ (আবু দাউদ)
তাই দাফনের পরপরই প্রত্যেক মৃতব্যক্তির জন্য কবরের সাওয়াল-জবাব সহজ হতে বেশি বেশি দোয়া করা জীবিতদের ওপর মৃতব্যক্তির অধিকার।
৫. অসিয়ত ও দেনা পরিশোধ করা
জানাজা-দাফনের পর প্রথম কাজ হলো মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পদ থেকে তার ঋণ পরিশোধ করা। তারপর যে অসিয়ত করে গেছে, তা পূর্ণ করা। তবে যে ওসিয়ত মৃতব্যক্তি করে যান, তা পুরো সম্পদ দিয়ে নয়, বরং সম্পদের এক তৃতীয়াংশ থেকে আদায় করা।
এক সাহাবি হজ আদায় না করেই ইন্তেকাল করেন, অথচ তার ওপর হজ ফরজ হয়েছিল। তার ছেলে এসে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে জানতে চাইলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমার বাবা তো হজ না করেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ আদায় করব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন-
أَرَأَيْتَ لَوْ كَانَ عَلَى أَبِيكَ دَيْنٌ أَكُنْتَ قَاضِيَهُ؟ قَالَ: نَعَمْ، قَالَ: فَدَيْنُ اللهِ أَحَقّ
বলো তো, তোমার বাবার যদি কোনো ঋণ থাকত, তবে কি তুমি তা আদায় করতে? সাহাবি বললেন, হ্যাঁ, করতাম। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তবে আল্লাহর ঋণ (হজ) আদায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ।’ (নাসাঈ)
৬. ঈসালে সাওয়াব
ঈসালে সওয়াব তথা মৃত্যুব্যক্তির জন্য সাওয়াব পাঠানোর উদ্দেশ্যে দান-সদকা যেমন করা যেতে পারে, এর পাশাপাশি কোরআন তেলাওয়াত, নফল নামাজ, রোজা, কোরবানি, হজ ইত্যাদি সবই করা যেতে পারে।
মনে রাখতে হবে
দুনিয়ার এ জীবনে কেউ চিরস্থায়ী নয়। আখেরাতই সবার আসল গন্তব্যস্থল। পরকালের জীবন যেন সুন্দর হয়, সুখকর হয় সে জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা। সবার কাছের সব আপনজন মৃতব্যক্তিদের সব হক যথাযথভাবে আদায় করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা ঈমানি দায়িত্ব।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহর সব জীবিতদেরকে মুমূর্ষু ও মৃতব্যক্তির জন্য করণীয়গুলো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/এমএস