‘বইয়ের পাতায় প্রদীপ জ্বলে, বইয়ের পাতায় স্বপ্ন বলে। যে বই জুড়ে সূর্য ওঠে, পাতায় পাতায় গোলাপ ফোঁটে, সে বই তুমি পড়বে।’ বিভিন্ন কবিতার এমন সব চমৎকার পঙক্তিগুলো নিয়ে দেয়ালচিত্র দেখার পর মনে হয় ‘যেন দেয়ালে দেয়ালে স্বপ্ন আঁকা হচ্ছে।’
হবিগঞ্জ শহরের কালিগাছতলা এলাকার কয়েকটি দেয়ালে বই পড়ার গুরুত্ব নিয়ে বেশ কিছু দেয়াল লিখন বা অঙ্কন চোখে জুড়িয়ে যায়। আর এ কাজগুলো করছে ‘মুক্তাঞ্চল- সাহিত্য চর্চা কেন্দ্র, হবিগঞ্জ’ নামে একটি সাহিত্য সংগঠন।
‘কলম হোক শক্তি, সাহিত্যে সমৃদ্ধ হোক জীবন।’ এই স্লোগান নিয়ে ২০২০ সালের ৬ জুলাই ‘সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি হবিগঞ্জ’ নামে তারা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা স্কুল কলেজ পড়ুয়া কিছু শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে একই বছরের ২৯ জুলাই এর নাম পরিবর্তন করে ‘মুক্তাঞ্চল সাহিত্যচর্চা কেন্দ্র হবিগঞ্জ’ রাখা হয়।
শুরুতে এর সদস্য সংখ্যা ১৫ জন হলেও বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৫ জনে। দিনে দিনে শিশু কিশোররা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির যুগে শিশু কিশোরকে বইমুখী করতে দেয়াল লিখনকে তারা প্রচারণার একটি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছে। খুলেছে ফেইসবুক গ্রুপও।
সংগঠনের সদস্য সুদীপা বিশ্বাস বলেন, ‘আমরা এখন অনেক বেশি প্রযুক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। তাই চাচ্ছি সবার মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। বই পড়ার যেন অনুপ্রেরণা পায় সেজন্য আমরা দেয়াল লিখনকে একটি পদক্ষেপ হিসেবে মাত্র কাজ করছি।’
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ‘মনেরে আজ কহ যে, ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লহ সহজে’, ‘বইয়ের দোকান পরখ করলেই বেবাক সমাজ কোনদিকে যাইতাছে টের পাওয়া যায়’, ‘সাহিত্য সমৃদ্ধ হোক জীবন’, ‘কলম হোক শক্তি’ বই ও বইপড়া নিয়ে এসব উক্তি।
হবিগঞ্জ পৌরসভার ৩, ৫ ও ৬নং ওয়ার্ডের নোংরা দেয়ালগুলো পরিষ্কার করে এসব পঙক্তিগুলো লিখে চলেছে কিছু তরুণ শিক্ষার্থী। দেয়ালে শোভা পাচ্ছে বাংলার লোক সংস্কৃতির কিছু গ্রাফিতিও। তারা সফলতাও পাচ্ছে অনেক। ক্রমেই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে।
এ সংগঠনের সদস্যরাই বই সংগ্রহ করে দেয়। বই পড়া শেষে পাঠকরা আবার তাদের ফেইসবুক গ্রুপে রিভিউও দেয়। এতে সংগঠনের সদস্যরা যেমন আনন্দ পাচ্ছে, তেমনি কাজ করতে উৎসাহ বাড়ছে কয়েকগুণ।
এই সংগঠনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা নিজেদের মধ্যে বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি এবং তরুণ সমাজের মধ্যেও বই পড়ার গুরুত্ব ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যেই মূলত সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন।
তিনি বলেন, ‘লক্ষ্য পূরণ করতে আমরা নিয়মিত সাহিত্য আড্ডা, কবিতা লেখা, বই পড়ার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সপ্তাহে বই নিয়ে আলোচনার আয়োজন করি। প্রযুক্তিনির্ভর তরুণ সমাজকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে দেয়ালে চিত্র লেখা আমাদের প্রথম পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে আমরা সচেতনতা বাড়াতে চাই।’
সংগঠনের আহ্বায়ক সম্পন্ন মহাপাত্র জানান, ‘কলম হোক শক্তি, সাহিত্যে সমৃদ্ধ হোক জীবন।’ এই স্লোগান নিয়ে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরই মধ্যে ফেইসবুক গ্রুপে তারা নিজেরা একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছেন। যার মাধ্যমে যে কেউ চাইলে নিজেদের লেখা কবিতা, গল্প, ছড়া, উপন্যাস প্রকাশ করতে পারেন।
তিনি আশা প্রকাশ করেন, এর মাধ্যমে তারা নিজেরা বই পড়া এবং লেখালেখিতে আগ্রহী হয়ে উঠবেন। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইচ্ছে করলেই সবাইকে একসঙ্গে বই পড়ায় আগ্রহী করে তুলতে পারবো না। ধীরে ধীরে অনেকেই এখন আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’
‘আমরা একটি মুক্ত লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করতে চাই। তবে আমরা সবাই যেহেতু শিক্ষার্থী তাই অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। অর্থনৈতিক বিষয়ও আছে। তবে কেউ চাইলে সহযোগিতা করতে পারেন। আমরা আশা করি একদিন এ সংগঠনের কার্যক্রম দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়বে।’
এই সংগঠনের সঙ্গে কাজ করা কাউন্সিলর পান্না কুমার শীল জানান, তাদের কার্যক্রম নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। সৃজনশীলতার মাধ্যমে তারা এরই মধ্যে নতুনত্ব তৈরি করতে পেরেছে। তিনি সাধ্যমতো তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
শুধু বই পড়া নয়, কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ‘রিভিউ মেটাফোর’ বই পর্যালোচনা প্রতিযোগিতা, রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ‘রৌদ্রকন্ঠে মুক্তিবার্তা’ কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।
এছাড়াও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে মুক্তাঞ্চল সাহিত্য সাময়িকীর ‘নবপ্রভা’ প্রকাশ, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ৫০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার হাতের ছাপ নিয়ে মানচিত্র তৈরি করাসহ নানা কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সৈয়দ এখলাছুর রহমান খোকন/জেএমএস/এমএস