শনিবার, ৩০ অক্টোবর, ২০২১

সন্তান মানেই টাকা রোজগারের মেশিন নয়

ছোটবেলায় শুনতাম ‘সুদখোর’ মানে মানুষের কাছ থেকে ধার নিয়ে বিনিময়ে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া। বিভিন্ন চাকরির ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত টাকা দিতে হলে সেটাকেও সুদ বলা হত! সময়ের বিবর্তনে সবকিছুই বদলায়। সেটা খুবই স্বাভাবিক। এখন আর ‘সুদ’ নামক শব্দটির কথা খুব একটা শুনি না। তার মানে এই নয় সুদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে! তা এখন নতুন মোড়কে ঘুষ নামক শব্দে রূপান্তিত হয়েছে।

মানুষ ব্যাংকে টাকা বিনিয়োগ করার কারণ তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা ও কিছু সমস্যার সমাধান করা ইত্যাদি। ঠিক তেমনি প্রায়শই পিতা-মাতা সন্তান জন্ম দেন তাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা, বংশের প্রজন্ম বিস্তার করা ও বৃদ্ধ বয়সে তাদের দেখাশোনা করার জন্য। আমি মনে করি বৃদ্ধ বয়সে মাতা-পিতাকে অবহেলা করা কিংবা বৃদ্ধাশ্রমে রাখা যতটুকু পাপ ঠিক ততটুকুই পাপ পিতা-মাতারা যখন সন্তানের প্রাণবন্ত জীবনটাকে পণ্য মনে করেন। যদিও এই রকম পণ্যবাজি পিতা-মাতার সংখ্যাটা অনেকাংশ কমে এসেছে।

এবার আসেন যে সত্য সচরাচর বলা হয় না রীতিমতো মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়! সেটা নিয়ে কিছু আলাপ করি, এখন মিডিয়ার যুগ পত্রিকা, অনলাইন পোর্টাল, ফেসবুক ইত্যাদিতে পিতা-মাতাকে সন্তান দেখাশোনা করে না এই ধরনের নিউজ প্রায়ই ভাইরাল হয়, নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। আমিও সেগুলোকে তীব্র নিন্দা জানাই এবং মন থেকে ঘৃণা করি। যে পিতা-মাতার সীমাহীন কষ্টের ফলে পৃথিবীতে সন্তানের আগমন হওয়া।

পিতা-মাতাকে অবহেলা করা! এর থেকে বড় কোনো পাপ আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু অধিকাংশ বাবার নীরব মানসিক নির্যাতনে হাজার হাজার সন্তানের জীবনটা বিষাক্ত হয়ে যাচ্ছে! কটূক্তি আর শারীরিক মানসিক অত্যাচারে সন্তানের আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি, ভবিষ্যত ইত্যাদি নষ্ট করে দেওয়ার হাজার ঘটনাও আমরা কমবেশি সবাই জানি এবং শুনি।

কিন্তু কেউ তা প্রচার করি না! কারণ সব পিতা-মাতার বক্তব্য তারা সন্তানের মঙ্গলের জন্য এগুলো করে থাকেন ধরা যাক ভালোর জন্যই করেন কিন্তু তারা কী জানতে চান সন্তান কীভাবে ভালো থাকতে চায়? মোদ্দা কথা পিতা-মাতারা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সন্তানদের ভালো মন্দের বিচার করেন সন্তানদের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়!

অপরদিকে দেখবেন স্বামী, স্ত্রীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে অনেকেই মুখ খোলেন এবং প্রচার করেন আমি সেটারও পক্ষে। কিন্তু কোনো সন্তানকে দেখিনি পিতা-মাতার অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে। তারা নীরবে নিভৃতে সহ্য করে যায়, কাউকে দেখিনি এই নিয়ে এক কলম আজ পর্যন্ত লিখেছে বা প্রচার করেছে! আর যদি বাস্তবিক জীবনে কেউ করেও থাকেন তা হলে সেটা আমার নজরে আজ অবধি আসেনি। সত্যি কিছু কষ্ট মানুষ কেবল খুব নীরবে সহ্য করে যায়। কিছু কষ্ট কাউকে বলা যায় না খুব কাছের মানুষকেও না।

দয়া করে আপনারা যারা পিতা-মাতা হয়েছেন সন্তানের প্রতি একটু সদয় হবেন। আপনার সন্তান কেবল আপনার টাকা রোজগারের মেশিন নয়! তারও একটা মন আছে, তারও একটা স্বপ্ন আছে, তারও দুঃখ কষ্ট হয়, তার ইচ্ছে হয় নিজের মতো করে বাঁচতে, দয়া করে বুঝতে চেষ্টা করুন। হাজার হাজার সন্তান কেবল তাদের পিতা-মাতার কারণে আজ সম্ভাবনা আর যোগ্যতা থাকার পরেও জীবন থেকে ছিটকে গিয়েছে এবং যাচ্ছে!

যারা আজ জীবনে ব্যর্থ বা কাঙ্খিত সাফল্য পায়নি খোঁজ নিয়ে দেখবেন তাদের অনেকের জীবনে এমন কিছু ইতিহাস আছে। শুধুমাত্র পিতা-মাতার মুখের দিকে তাকিয়ে সন্তানরা নীরবে হাজার হাজার বার মরে যাচ্ছে! সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে তাকে মানসিকভাবে হত্যা করার অধিকার কোনো জন্মদাতার থাকে না! থাকে কী?

অনেক ছেলে-মেয়ে আছে যারা একে অপরকে ভালোবাসে এক সঙ্গে বাকি জীবনটা কাটানোর স্বপ্ন দেখে কিন্তু পিতা-মাতারা সন্তানদের স্বপ্নকে কবর দিয়ে তাদের পছন্দমত বিয়ে দেন। এখানেইতো আপনার জীবিত সন্তানের ভবিষ্যৎ জীবনকে গলা টিপে হত্যা করে দিলেন! মরে বেঁচে থাকে তারা একমাত্র পরিবারের কথা চিন্তা করে।

মানব, সমাজ, ও ইতিহাস নিয়ে পাঠ্যপুস্তক খানিকটা পড়েছি, আচ্ছা- ধরে নিন আমি পাঠ্যপুস্তক তেমন পড়ি নাই ইতিহাসও তেমন একটা জানি না। ক্ষুদ্র অভিজ্ঞা থেকে বলছি অনেক পরিবারকে দেখেছি মেয়ে সন্তান জন্ম হলে পিতাসহ পরিবারের সবাই তেমন একটা খুশি হতেন না কারণ মেয়ে জন্ম নিলেতো রোজগার হবে না বরং ভরণপোষণ করে একটা সময় বিয়ে দিতে হয় তখনও টাকার ব্যয়!

আমরা চার ভাই, বোন নেই! অনেকেই বলতেন তোমারত বোন নেই কোনো চিন্তা নেই! পিতা-মাতাকে বলতেন তোমাদেরতো মেয়ে নেই বিয়ের খরচ থেকে বেঁচে গেলে! এই ধরনের কথাগুলো যখন শুনতাম তখন খুব অবাক হতাম আর মনে মনে ভাবতাম এরা এতটাই কম শিক্ষিত, এতটাই অমানবিক লেখাপড়ার বালাই কি তাদের মধ্যে একদম নেই! নাকি কয়েকটা সার্টিফিকেট আর একটি চাকরি পর্যন্তই তাদের লেখাপড়া সীমাবন্ধ!

তারা কী জানে না কাজী নজরুলের কবিতা ‘সাম্যের গান গাই- আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই! বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। সিমোন দ্য বোভোয়ার বলেছিলেন ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী’। তবে বর্তমানে সমাজের টাবু ভেঙে অনেকটাই এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।

তারা এখন আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নিজেদের সন্তান জন্ম দেওয়ার মেশিন ভাবে না, পুরুষতান্ত্রিক প্রথার দাসি ভাবে না। তারা এখন নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজেদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে শিখেছে। সারা বিশ্বে এখন পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীরাও কাজ করে যাচ্ছে।

তবে নারীদের বাস্তবিক যাপিত জীবনেও এখনো রয়েছে পুরুষতান্ত্রিকতার অনেক প্রভাব। তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি নারী পুরুষ মিলে এই পৃথিবীটা একদিন মানুষের হবে। এখানে নারীবাদের কোনো প্রসঙ্গ আমি টানি নাই শুধু মেয়ে সন্তান জন্মালে মানুষদের অনুভূতি তুলে ধরতে গিয়ে এই প্রসঙ্গগুলো যুক্ত করতে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি নারীবাদের মূলমন্ত্র ‘শুদ্ধতম মানুষ হওয়া’।

এবার আসেন পুঁজিবাদের শুরুটা নিয়ে একটু আলাপ করি, পুঁজিবাদের বৃত্তে মাত্র ১২ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে যখন এগ্রিকালচারাল রেভ্যুলুশন শুরু হয় তখন মানুষ টিকে থাকার স্বার্থে প্রথম শ্রমিকের উপযোগিতা নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তারপর অবিষ্কার করেন একজন পুরুষ যদি জমিতে লাঙ্গল দেন এবং একজন নারী যদি গন্ডা গন্ডা সন্তান জন্ম দিয়ে লাঙল দেওয়ার মতো শ্রমিক তৈরি করতে পারেন! তা হলে হয়তো সব থেকে বেশি ফসল উদ্বৃত্ত থাকে। এইটা একদিনে হয় নাই এই ঘটনা ঘটতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগেছে।

পরিশেষে বলছি, পৃথিবীর সকল পিতা-মাতাকে আমি ঈশ্বরের থেকে বড় মনে করি। পৃথিবীর সব পিতা মাতাদের প্রতি আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করে বলছি দয়া করে আপনারা মেয়ে জন্ম নিলেই তার ভরণপোষণ করে বিয়ে দেওয়া, আর ছেলে জন্ম নিলে টাকা রোজগারের মেশিন ভাববেন না।

ছেলে হোক মেয়ে হোক প্রথমে তাদের মানুষ হতে সহযোগিতা করুন তাদেরকে শুদ্ধতম মানুষ হিসেবে গড়ে তুলুন তারপর দেখবেন তারা নিজ থেকে নিজেদের তাগিদে, জীবনের তাগিদে, জীবিকা সরবরাহ করবে সংসার করবে নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করবে। অতপর পিতা মাতাকে ঈশ্বরের উর্দ্ধে ভাববে। আর নয়তো একদিন দেখবেন পৃথিবীর অলিতে গলিতে প্রতিটি ছেলে-মেয়েদের দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে ধ্বনিত্ব হবে নির্বাসিত দাউদ হায়দারের সেই কবিতার লাইন ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’।

এমআরএম/এমএস



Advertiser