গণতন্ত্র মানে বাক-স্বাধীনতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, বিশ্বাস, সৃজনশীল নাগরিক হিসাবে নিরাপদে ও গর্বের সঙ্গে দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করা। মতামতের ভিন্নতা ও খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে যখন ঐক্যের সমন্বয় ঘটে তখন জাতি স্বাধীনতার সুফল ভোগ করে। পুলিশ বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, রাজনীতিবিদ বা সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যখন ভয়ংকর রূপ ধারণ করে তখন সে গণতন্ত্র জাতির জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায় বিধায় অপ্রিয় সত্য কথা বা সামাজিক আলোচনার বিষয়সূচি থেকে বঞ্চিত হয় জাতি।
সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে ব্যক্তিসত্তা ও সুসম্পর্ক নষ্ট হয়, হারাতে বসে মনুষ্যত্ব, বিলীন হয় গণতন্ত্র, আর তখনই সৃষ্টি হয় দেশে অরাজকতার।
গণতন্ত্র মানে যদি ঘুস, দুর্নীতি, অরাজকতা, নকল, অবিচার এসব হয় তাহলে সশস্ত্র বাহিনী মাঠে নামলে গণতন্ত্রের অবমাননা কেন হবে? গণতন্ত্র কাগজে কলমে বা মুখে বললেই কি হবে? এজন্য দরকার সর্বোত্তম চর্চা ও কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকতে হবে।
স্বাধীনতা অর্জনের ৫০ বছর পরেও গণতন্ত্রের চর্চা আমাদের সমাজে হয়নি। আজ অন্ধকারে থাকা কিছু সত্যকে আলোকের সম্মুখে তুলে ধরতে চাই দেশ ও জাতির সার্বিক মঙ্গলের জন্য। একটি উন্নয়নশীল জাতির বাজেটের বড় অংশ ব্যয় করা হচ্ছে বাংলাদেশ সশস্ত্র, বর্ডার গার্ড, র্যাব, পুলিশ বাহিনীর জন্য। কারণ তাদের সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে দেশকে শতভাগ শান্তি ও স্বস্তিতে রাখার জন্য।
সোনার বাংলা গড়ার ও অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রুর থেকে দেশকে মুক্ত রাখার জন্য দেশের মেহনতি মানুষের উপার্জিত অর্থ থেকে তাদের বেতন থেকে শুরু করে সব সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় যাতে করে তারা সক্রিয়ভাবে দেশের শৃংখলা রক্ষার্থে সঠিকভাবে কাজ করতে পারে।
দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে মুক্ত করলেই কী কাজ শেষ হয়ে গেলো? দেশকে অন্ন-বস্ত্রের অভাবমুক্ত, কুশিক্ষা মুক্ত, পরাধীন চেতনা মুক্ত, দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে। সোনার বাংলা গড়তে হলে যারা বর্তমান নানা দায়িত্বে আছে তাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
আমার ভাবনার সঙ্গে জড়িত জীবনের অভিজ্ঞতার কিছু কথা যা অপ্রিয় সত্য কথা। শুরু করি ভাষা আন্দোলন দিয়ে। কারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভাষা আন্দোলনে? সালাম,বরকত, রফিক, শফিক আরও কত অজানা নাম, এরা সবাই গ্রামের ছেলে। দেশ স্বাধীন করার জন্য কারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? কারা জীবন দিয়েছিল? জাতির পিতা থেকে শুরু করে যাদের নাম আসবে তারা সবাই গ্রামের ছেলে।
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ, আমরা গ্রামের ছেলে-মেয়েরা সব সময় ঝাঁপিয়ে পড়ি দেশের স্বার্থে, দেশ গড়ার স্বার্থে, দেশকে বহিঃশত্রুর থেকে রক্ষা করার স্বার্থে। অথচ সব সময় দেখেছি, ভালো কিছু করতে, ভালো কিছু গড়তে, ভালৈা কিছু ভোগ করতে, তা হবে বা হচ্ছে শহরে। যুদ্ধের সময় যারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ছিল পৃথিবীর অনেক দেশে, যাদের সামর্থ্য ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সাহায্য করার, যারা সহজেই দেশ ছাড়তে পেরেছিল এদের বেশিরভাগই ছিল শহরকেন্দ্রিক।
যারা আমাদের দেশ গড়ার কাজে আমাদের সাথে ছিল না, থাকেনি বা থাকবে না তাদের আমরা রাজাকার বলি। কিন্ত যাদের সাথে আমাদের মতবিরোধ বা অন্য ধর্মে বা বর্ণে বিশ্বাস বা চিন্তা ধারার ভিন্নতা রয়েছে তাদের ওপর হস্তক্ষেপ করতে আমরা পারি না। তাতে মানব জাতির অকল্যাণ হবে ও মনুষ্যত্বের অবনতি ঘটবে। আমরা অবশ্যই এগ্রি টু ডিজ এগ্রি হতেই পারি।
আমি মনে করি যারা ক্ষমতায় থেকেও তার সদ্ব্যবহার করছে না, যারা অন্যকে বিনা অপরাধে অপরাধী করছে, যারা অসৎ পথে অর্থ সঞ্চয় করছে, যারা দুর্নীতি করছে, যারা মাদক বা মাদকের চেয়ে বিষাক্ত জিনিস দেশে আনছে বা আনতে সাহায্য করছে তাদের আমরা রাজাকার বলতে পারি কারণ তারাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে দেশের শত্রু। এদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যেমনটি পড়েছিলাম অতীতে।
কিন্তু এখন একটু সমস্যা আছে তা হলো তারা ছিল বহিঃশত্রু আর এরা হচ্ছে আমার/আমাদের নিজের লোক, কেউ আমার বাবা, কেউ আমার মামা, কেউ আমার চাচা, কেও আমার বন্ধু কেউ আমার বন্ধুর বন্ধু, তাই এদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বড় কঠিন!
বর্তমান রাজনীতির অবস্থা হয়েছে আরও জঘন্য। তারা নিজেরাও জানেন না তারা কী করছেন, তারা দেশকে ধ্বংস ও অন্ধকারে ফেলে ইচ্ছেমতো লুটপাট করছেন। বিরোধী দলের অনেকেই এখন জেল হাজতে দুর্নীতির কারণে, যারা ক্ষমতায় বর্তমান তারাও কিন্তু সেই একই কাজগুলো করছেন। পরে ক্ষমতাচ্যুত হলে তারাও জেল হাজতে যাবেন। বাবা-মা, বা দাদা দেশের মন্ত্রী ছিলেন এখন বংশের চোদ্দগুষ্টি সেটা ভোগ করছেন।
তারা ভুলে গেছেন বাংলাদেশে ১৭-১৮ কোটি লোকের বাস ও তাদেরও একটা অধিকার রয়েছে তাদের জন্ম ভূমির ওপর। এটা কি গণতন্ত্র, রাজতন্ত্র, ভণ্ডামি নাকি ভোগতন্ত্র? কবে না শুনি যে বর্তমান যারা জেনারেল, সচিব বা উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা আছেন তাদের ছেলে-মেয়ে পরে সেই পদ দখল করছেন জন্মসূত্রে। কী হচ্ছে দেশে? আর কতদিন চলবে এসব অরাজকতা?
জাতির পিতার কন্যার কাছে অনুরোধ, আপনার বাবার স্বপ্ন ছিল সত্যিকারে সোনার বাংলা গড়ার। আপনি দায়িত্বে যখন আছেন দয়া করে দু্র্নীতিগ্রস্ত সবাইকে নিজের হাতে জেল হাজতে ঢুকিয়ে ভালো মানুষের সঙ্গে হাতে হাত রেখে আপনার বাবার স্বপ্ন কিছুটা হলেও বাস্তবায়ন করে যান।
এখনো কিছু লোক আছে যারা সত্যিকারের গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, তাদের নেত্রীত্বে দেশের সবাইকে একত্রে কাজে লাগিয়ে সুশিক্ষার মধ্য দিয়ে সোনার বাংলা গড়াই হোক জাতির পিতার স্বপ্নের বাস্তবায়ন। রাজতন্ত্র, ভণ্ডামি বা ভোগতন্ত্র নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সোনালি ঢেউ দেখতে চাই।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস