ছোট পোশাক পরে বিপরীত লিঙ্গকে প্রলুব্ধ করা বন্ধ করো, বলা হচ্ছে। এই প্রতিবাদে একদল রাস্তায়ও নেমেছে। চলছে পক্ষে-বিপক্ষে প্রতিবাদের লড়াই। বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে স্পষ্টভাবে দেখা যায়, সৌদির নারী-পুরুষ এ ব্যাপারে শালীনতা বজায় রেখেছে তবে বাংলাদেশের মত অনেক মুসলিম দেশ রয়েছে সেখানে নারীদের শরীর ঢাকতে হবে এটাই এ যাবত হয়ে আসছে।
এই প্রথম বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক লোক এটা নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। দেখা যাক বিষয়টির শেষ কোথায় এবং কীভাবে গিয়ে থামে!
আন্দোলনের ব্যাপারটা নিয়ে মতামত দেওয়ার আগে কিছু তথ্য তুলে ধরি তার আগে। আজ থেকে প্রায় চল্লিশ বছর আগের অনুভূতি, সবে তখন সুইডেনে এসেছি। হঠাৎ দেখি প্রচণ্ড শীতে গাছগুলোর পাতা ঝরে পড়ে গেলো, দেখে মনে হলো সবকিছু মরে গেছে। কিছুদিন পরে সেই ন্যাংটা গাছগুলো তুষারে ঢাকা পড়ে এক অপূর্ব নতুন রূপ ধারণ করলো। মানুষের মুখ ছাড়া কিছুই দেখার উপায় নেই।
বরফ গলে গেল, আস্তে আস্তে শীতের দাপট কমতে শুরু করলো। সূর্যের কিরণ দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো, আবার গাছগুলো তার নতুন জীবন ফিরে পেলো। নর-নারী তার দেহের কাপড় হাল্কা পাতলাভাবে পরতে পরতে, কোনো এক সময় সূর্যের আলোকে নিজেদের উজাড় করে দিলো। দেখে মনে হলো অপূর্ব এক নিদর্শন; যার মধ্যে রয়েছে জ্বলন্ত জীবন! অন্যরকম অনুভূতি এসেছিল হৃদয়ে, না দেখলে সারাজীবন হয়ত শুধু কল্পনাই করতাম। সৌন্দর্যের এত রূপ স্রষ্টার সৃষ্টিতে, জানতাম না জীবনে না দেখলে নিজ দৃষ্টিতে।
সে বহু বছর আগের কথা হলেও আজও মনে পড়ে সে সময়ের স্মৃতিগুলো। এখন ছাগল, গরু, হাঁস, মুরগীর ক্ষেত্রে একটি জিনিস বেশ পরিষ্কার সেটা হলো জন্ম থেকেই কিন্তু তাদের লজ্জাস্থানের ওপর একটি পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। গরু ছাগলের লেজ এবং হাঁস, মুরগীর শরীর ভরা লোম যার কারণে এরা একে অপরের লজ্জাস্থান সরাসরি দেখতে পায় না, তার অর্থ এই নয় যে পশুপাখির যৌন সংযম হয় না, অবশ্যই হয়।
এখন মানুষ জাতিকে সৃষ্ট করা হয়েছে উলঙ্গ করে, পরে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে লজ্জাস্থানের ওপর চুলের একটি আবরণ পড়েছে। শরীরের ওপর নানা ধরনের পরিবর্তন দেখা দিয়েছে, মূলত নারী-পুরুষ অন্যান্য জীবজন্তুর মত যাতে আকৃষ্ট হয়। এটা একটি বেশ সহজ সরল বিষয়। আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারণে, শীত নিবারণের কারণে মানুষ শরীরকে নানাভাবে ঢাকতে শুরু করে পরে কাপড়ের ব্যবহার শুরু হয়। এখন সেই কাপড়ের কারণে শুরু হয়েছে নতুন সমস্যা আর সেটা হলো কে কীভাবে কতটুকু কাপড় পরছে বা পরছে না!
এবার আসা যাক কিছু ব্যক্তিগত রিফ্লেকশন বা ঘটে যাওয়া ঘটনার ওপর আলোচনা। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে আমি আমার স্ত্রী মারিয়াকে নিয়ে বাংলাদেশ যাই। আমার স্ত্রীর বাবা স্পেনিশ এবং মা সুইডিশ। মারিয়া মাল্টি কালচার এবং বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে বেশ সচেতন এবং মত-দ্বিমতের ওপর যথেষ্ট সম্মান রেখে সে কথাবার্তা এবং চলাফেরা করে থাকে।
বাংলাদেশে তার স্বল্প কয়েকদিনের ভ্রমণে শাড়ি বা স্যালোয়ার কামিজ পরা এবং জনসম্মুখে শালীনতা বজায় রেখে চলাফেরা করাটাকে বাংলাদেশের কালচারের একটি অংশ হিসেবেই সে মেনে নিয়েছে। তবে যে ঘটনাটি বর্তমান আন্দোলনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ঠিক একই প্রশ্ন করেছিল সে আমাকে আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে।
মারিয়ার রিফ্লেকশন ছিল, ‘এ কেমন অবিচার নারীর প্রতি? নারীদের শরীর ঢাকা অথচ পুরুষরা দিব্বি খালি গায়ে রাস্তা, ঘাটে, মাঠে, বাড়িতে ঘুরে বেড়াচ্ছে? নারীদের কি পুরুষের শরীর দেখলে প্রলুব্ধের ভাব জাগে না? আমাদের দেশে (সুইডেনে) আমরা নারী-পুরুষ সবাই হাল্কা পাতলা কাপড় পরি, কিন্তু তোমাদের দেশে তো পুরোপুরি ডিস্ক্রিমিনেশন? এ এক আজব জায়গা, শুধু নারীদের প্রতি অবিচার। শুধু নারীর ওপর অত্যাচার? এটা অন্যায় ইত্যাদি, ইত্যাদি।
সুইডেনে সৌদি আরবের মত নারী-পুরুষ একই ফিলোসফিতে বিশ্বাসী পার্থক্য শুধু সৌদিতে উভয়ের শরীর কাপড়ে ঢাকা আর সুইডেনে বিশেষ করে গরমে কাপড় অনেক সময় নেই বল্লেই চলে। আমি মনে করি নারীর দেহ দেখলে আমি যেমন আকৃষ্ট হই নারীর প্রতি তেমনি নারীরাও কিন্তু ঠিক একই ভাবে পুরুষের উলঙ্গ শরীর দেখলে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। আমার এই মনে করাটার সঙ্গে যদি কারও দ্বিমত থাকে তবে বলব, তার লিঙ্গ জ্ঞান সম্পর্কে কোনো ধারনা নেই অথবা তার শরীরে সেটা কাজ করে না, যাকে বলা হয় নিউটার জেন্ডার। এর চেয়ে বেশি নাইবা লিখি।
ভালোবাসা যার মাঝে জীবনে আসেনি, সে কখনও ভালেবাসতে শেখেনি। প্রেম জীবনে আসবে বারবার, কিন্তু মরণ হবে জীবনে একবার। ভালোবাসার মধ্যে শুধু রয়েছে ভালোবাসা। নর-নারীকে নিয়ে ভাবতে ক্ষতি নেই, তবে ভালোবাসতে ভুলে গেলে চলবে না, কষ্ট দেওয়া যাবে না এবং পরস্পরকে সম্মান করতে হবে। স্রষ্টার সৃষ্ট জীব হয়ে জন্মেছি, অমানুষ হয়ে যেন না মরি।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/এমএস