নতুন বছর মানেই নতুনভাবে জীবন এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন। ৩১ তারিখের রাত ১২টার পরপরই ঝলমলে আতসবাজি আর ফানুসের ছড়াছড়ি জানান দেয় চলে এসেছে নতুন বছর। ইংরেজি নববর্ষ পুরো বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। ২০২১ কে বিদায় জানিয়ে ২০২২ সালকে বরণ করে নেবে বিশ্ববাসী।
তবে জানেন কি, শুধু আতসবাজি, ফানুস আর পার্টি বা অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই নববর্ষ পালন করা হয় না সব জায়গায়। বিভিন্ন দেশ নিজেদের রীতি ও সংস্কৃতি মেনে যেভাবে নতুন বছরকে বরণ করে নেয়। মেতে ওঠে নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনে! বিশ্বের নানা দেশের নানা রকম অদ্ভুত নববর্ষ উদযাপনের সংস্কৃতি আছে।
নিউ ইয়ার সেলিব্রেশনের প্রথম রেকর্ড পাওয়া যায় খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের কাছাকাছি সময়ে তত্কালীন ব্যাবিলনে। সে উত্সব ব্যাবলিনীয়রা পালন করত বসন্তে, মার্চের শেষভাগে যখন বিষুব অঞ্চলে দিন ও রাত সমান দৈর্ঘ্যে উপনীত হতো।
দিনটি তারা স্মরণীয় করে রাখত ‘আকিতু’ নামে জাঁকজমকপূর্ণ এক ধর্মীয় উত্সব আয়োজনের মাধ্যমে। এটিকেই তারা নববর্ষ হিসেবে পালন করত। এবার জেনে নিন কোন দেশ কীভাবে পালন করে নতুন বছর-
ইকুয়েডর
কাকতাড়ুয়া পোড়ানোর মধ্য দিয়ে ইকুয়েডরে নববর্ষ পালন করা হয়। এভাবে নতুন বছরে খারাপ ভাগ্যকে বিদায় দেন ইকুয়েডরবাসীরা। কাকতাড়ুয়া তৈরি করে প্রতিটি পরিবার মাঝরাতে তা পোড়ায়। তাদের বিশ্বাস, কাকতাড়ুয়া পোড়ালে তা সবার জন্য নতুন বছরে সৌভাগ্য বয়ে আনবে।
স্কটল্যান্ড
স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গে তিন দিনব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় তাদের উদযাপন। এদিন ৮ হাজার মানুষ টর্চলাইট হাতে নিয়ে রাস্তায় ‘রিভার অব ফায়ার বা আগুনে নদী’ তৈরি করেন। সেই শোভাযাত্রার তালে তালে চলতে থাকে ড্রাম ও বংশীবাদকের দল।
জানুয়ারির ১ তারিখে তারা একটি পারিবারিক মিলনমেলার আয়োজন করে থাকেন, যেখানে তাদের আত্মীয়স্বজন-বন্ধুবান্ধবরা অংশ নেন। নিজেদের তৈরি একধরনের মদ পান করেন সবাই। সেই সঙ্গে চলে স্কটিশ মিউজিক ও ট্র্যাডিশনাল নাচ ও গল্প। এই অনুষ্ঠানকে বলা হয় ‘সিলিধ’। সবাই তাদের বন্ধুবান্ধবদের বাসায় লবণ, কয়লা, পাউরুটি ও হুইস্কি ইত্যাদি উপহার হিসেবে নিয়ে যান।
ডেনমার্ক
ড্যানিশরা নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসেবে প্রতিবেশীদের বাড়ির সামনে বাসনপত্র ছোড়াছুড়ি করেন। তাদের বিশ্বাস, যার বাড়ির সামনে সবচেয়ে বেশি বাসন থাকবে, সে সবচেয়ে বেশি সৌভাগ্যবান। কারণ তার সবচেয়ে বেশি ভালো বন্ধু আছে।
জার্মানি
প্রতিবছর নিউ ইয়ার ইভ, অর্থাত্ নববর্ষের আগের রাতে জার্মানরা ব্রিটিশ শো ‘ডিনার ফর ওয়ান’ দেখে নববর্ষ উদযাপন শুরু করে। ১৯৭২ সাল থেকে আজ অবধি এই এক শো দেখে নববর্ষ উদযাপন করছে তারা।
স্পেন
১২টি আঙুর খেয়ে স্পেনের মানুষ নতুন বছর বরণ করেন। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজার আগেই মাদ্রিদের প্লাজা ডি এস্পানায় জড়ো হয় অসংখ্য মানুষ। তারপর বছরের শেষ ১২ সেকেন্ড, অর্থাত্ ১২টা বাজার আগের শেষ ১২ সেকেন্ডে প্রতি সেকেন্ডে একটি করে আঙুর খাওয়া হয়। এভাবেই নতুন বছরকে বরণ করে নেয় স্প্যানিশরা।
ফিলিপাইন
গোল আকৃতিকে সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করেন ফিলিপাইনের মানুষেরা। তাই নববর্ষে গোল জিনিস দিয়ে মাতিয়ে তোলেন। উপহারে গোল কয়েন দেন। বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে এদিন তারা খান গোলাকৃতির খাবার।
দক্ষিণ আমেরিকা
দক্ষিণ আমেরিকার বর্ষবরণ উদযাপিক হয় রংবেরঙের অন্তর্বাসে পরে। তারা বিশ্বাস করে, অন্তর্বাসের রঙের সঙ্গে ভাগ্যের সম্পর্ক আছে। যার ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন, তিনি লাল অন্তর্বাস পরেন। যার শান্তি প্রয়োজন তিনি বেছে নেন সাদা ও যার সম্পদ প্রয়োজন তিনি পরেন সোনালি রঙের অন্তর্বাস।
জাপান
জাপানের মানুষরা নতুন বছরকে বরণ করে নেয় ঘণ্টা বাজিয়ে। মন্দিরের ঘণ্টা ১০৮ বার বাজিয়ে নতুন বছরের আগমন উদযাপন করে তারা। তাদের ধারণা, ১০৮ বার ঘণ্টা বাজালে জীবনের ১০৮টি ইচ্ছা পূরণ হবে ও ১০৮টি বিপদ কেটে যাবে।
সুইজারল্যান্ড
আইসক্রিম খেয়ে ও মেঝেতে ফেলে বর্ষবরণ করেন তারা। তাদের বিশ্বাস, এতে তাদের জীবনে সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধি আসবে।
চীন
চীনের বর্ষবরণ উৎসবে থাকে রঙের ছড়াছড়ি। তারা বাড়ির সামনের দরজায় লাল রং করেন। বড়রা লাল খামে টাকা ভরে তাদের ছোটদের দেন। আকাশে দেখা যায়, আতশবাজির ছটা। তাদের মতে, আতশবাজির শব্দ অশুভ আত্মাকে দূরে ঠেলে দেয়।
চিলি
মৃত ব্যক্তিদের সঙ্গে নববর্ষ উদযাপনের রীতি আছে চিলিতে। জানা যায়, ১৯৯৫ সালে দেশটির টালকা নামক এক ছোট শহরের কবরস্থানের প্রাচীর পাড়ি দিয়ে বাবার সঙ্গে নববর্ষ উদযাপন করতে ভেতরে ঢুকেছিল একটি পরিবার। এরপর থেকেই প্রতিবছর মাঝরাতে কবরস্থানে গিয়ে মৃত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে সবাই শুরু করেন নতুন বছর।
মেক্সিকো
মেক্সিকানরাও মৃত ব্যক্তিদের আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করে ও তাদের নববর্ষের শুভেচ্ছা জানায়। তারা বিশ্বাস করে, প্রিয় ব্যক্তিদের আত্মা তাদের কথা শুনতে পায়। তাই মৃত ব্যক্তিদের শুভেচ্ছা জানানোর মধ্য দিয়ে তারা নতুন বছর বরণ করে নেয়।
আয়ারল্যান্ড
আয়ারল্যান্ডের অবিবাহিত নারীরা অদ্ভুত এক রীতি পালন করেন নববর্ষের আগের রাতে। তারা বালিশের নিচে মিস্টলটো নামক লতানো গাছের পাতা রেখে দেয়। তাদের ধারণা, এই পাতা বালিশের নিচে রাখলে তারা ভালো বর পাবে ও দুঃখ-কষ্ট দূর হবে।
হংকং
প্রচুর পরিমাণ আতশবাজি ফাটিয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় হংকংবাসীরা। এদিন হংকংয়ের বিভিন্ন হোটেল থেকেও দৃষ্টিনন্দন এসব আলোকসজ্জা উপভোগ করা যায়।
দুবাই
বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু বাড়ি দুবাইয়ের বুর্জ আল খলিফায় নিউ ইয়ার উদযাপনের নানা আয়োজন করা হয়। আলোকসজ্জা ও আতশবাজির মাধ্যমে সেখানে নতুন বছর উদযাপন করা হয়ে থাকে। এর কিছুটা দূরে বুর্জ প্লাজাতেও বিপুল পরিমাণ আতশবাজির মধ্য দিয়ে নিউ ইয়ার উদযাপন করা হয়।
সিডনি
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ব্যাপক জাঁকজমকপূর্ণভাবে নিউ ইয়ার উদযাপন করা হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে সেখানে লোকজন আসে নতুন বছর বরণ করতে। নিউ ইয়ারের সময় অস্ট্রেলিয়ায় গ্রীষ্মকালের শুরু বলে বর্ষবরণের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র সৈকতে ইচ্ছামতো ঘুরেন পর্যটকরা।
ব্যাংকক
এশিয়ার অন্যতম জাঁকজমকপূর্ণ একটি শহর ব্যাংকক। রাত যত গভীর হয়, শহরটিও তত জেগে ওঠে। ব্যাংককের সেন্ট্রাল ওয়ার্ল্ড প্লাজা ও এশিয়াটিক শপিং সেন্টারের আশপাশে ভিড় জমে ওঠে নববর্ষ উদযাপনের।
কেপটাউন
দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে নিউ ইয়ার পালন করা হয় দৃষ্টিনন্দন আলোকসজ্জার মাধ্যমে। এ ছাড়াও নানা রকম সুস্বাদু খাবারের ব্যবস্থাও থাকে সেখানে।
লন্ডন
জাঁকজমক বর্ষবরণের তালিকায় লন্ডনের অবস্থান বেশ ওপরে। ইংল্যান্ডের টেমস নদীর ওপরের আলোকসজ্জা দেখার মতো দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এ ছাড়া নিউ ইয়ারের রাতে টেমস নদীতে ‘রিভার ক্রজ’ বিশেষভাবে আকর্ষণ করে দর্শকদের।
ভিয়েতনাম
ভিয়েতনামের অধিবাসীরা নতুন জামা পরে বর্ষবরণ করেন। আমস্টারডামে তাদের সবচেয়ে বড় উৎসব উদযাপিত হয়। রাস্তার ধারের রেঁস্তোরা থেকে ‘অলিবলেন’ নামের একধরণের খাবার কিনে খান। এগুলো খেলে নাকি তারা অশুভ জিনিস থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখতে পারবে।
পুয়ের্তো রিকো
সেখানকার মানুষেরা অশুভ আত্মা ও খারাপ জুজুকে বের করার জন্য জানালা দিয়ে পানি ফেলেন। এদিন তারা বাড়িঘর, রাস্তাঘাট সবকিছু পরিষ্কার রাখেন।
এ ছাড়াও, বেলজিয়ামের কৃষকেরা তাদের গরুকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে নতুন বছর শুরু করেন। বলিভিয়ার বাসিন্দারা মিষ্টি ও কেকের মধ্যে কয়েন লুকিয়ে রাখেন। যে কয়েনটা খুঁজে পাবে, পুরো বছরটা তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। কয়েন নদীতে ফেলে নতুন বছর উদযাপন করেন রোমানিয়ানরা।
অশুভ আত্মাকে দূর করার জন্য আয়ারল্যান্ড এর অধিবাসীরা দেয়ালে পাউরুটি ছুঁড়ে মারেন! অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষেরা ঘরের বাইরে পুরোনো আসবাবপত্র ছুঁড়ে ফেলেন।
সূত্র: বিজনেস ইনসাইডার/টাইমস অব ইন্ডিয়া
জেএমএস/এএসএম