রবিবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১

আমি যতদিন সুস্থ আছি অর্থহীন আপনাদের নিরাশ করবে না: বেসবাবা সুমন

দীর্ঘ ৪ বছর পর স্টেজে উঠলেন। গান শুরু হবার পর ১টা লাইন গাইলেন। তারপর হঠাৎ মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডটা ঘুড়িয়ে দিলেন শ্রোতাদের দিকে। হাজার হাজার দর্শক শ্রোতা চিৎকার করে মিউজিকের সাথে তাল মিলিয়ে গাইতে শুরু করলো সেই গান। কিছুক্ষণের মধ্যেই বসুন্ধরা অডিটোরিয়ামটার পরিস্থিতি কেমন যেন বদলে গেলো।

এভাবেই আবেগঘন এক রাত নেমে এসেছিলো ২৩ ডিসেম্বর ‘ঢাকা রক ফেস্ট ২’- তে। সেদিন মঞ্চে উঠেছিলেন অর্থহীন ব্যান্ডের সেই সুমন, সেই বিখ্যাত ক্ষ্যাপা বেসবাবা সুমন। যিনি বছরের পর বছর লড়াই করে চলেছেন মরণব্যাধি ক্যান্সারের সঙ্গে।

দীর্ঘদিন পর স্টেজে উঠে নিজেও আবেগে ভেসে গেলেন সুমন। সেই কথা নিজেই জানালেন দীর্ঘ স্ট্যাটাসে। সুমন লিখেছেন, ‘ডিসেম্বর ২৩, ২০২১। ঢাকা রক ফেস্ট ২। স্টেজে ওঠার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। অডিটোরিয়াম জুড়ে একটা আওয়াজ ঘুরপাক খেয়ে গ্রিন রুমে আসছিল, ‘অর্থহীন! অর্থহীন! অর্থহীন!’। আমার অনেক পরিচিত একটা নাম। এই নামটার সাথে যেন আমার একটা রক্তের সম্পর্ক হয়ে গেছে। ১৯৯২ সাল থেকে আমার অনেক ভালবাসা, অনেক কষ্ট, অনেক দুঃখ, অনেক রাগ, অনেক আনন্দ এবং আরও অনেক কিছুর সাথে এই নামটা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

সেই সময় নামটা ছিল ‘সুমন ও অর্থহীন’, ১৯৯৮ তে গিয়ে নামটা পরিবর্তন করে রাখি শুধু ‘অর্থহীন’। সেখান থেকে অফিশিয়ালি অর্থহীনের যাত্রা শুরু।

যাইহোক, ফিরে আসি ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে। গ্রিন রুম থেকে বের হয়ে স্টেজের সামনে আসলাম। খুব সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে স্টেজে উঠছিলাম। এর আগে ঢাকার কনসার্টে সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় আমার হাতে একটা লাঠি ছিল, আমাকে ধরে ওঠানোর জন্য সাথে দু-তিন জন মানুষ ছিল। অনেক অসুস্থ ছিলাম তখন। সেদিন স্টেজ থেকে নামার সময় জানতাম না আবার কবে উঠতে পারবো স্টেজে। কিন্তু সে সময় যখন স্টেজে উঠছিলাম তখন হাতে কোনো লাঠি ছিল না, আমাকে ধরার জন্য ছিল না কোনো মানুষ।

হাতে ছিল মাইকেল টোবায়ানের আমার জন্য বানিয়ে দেয়া নতুন একটি অনেক হালকা বেইস গিটার। আমাকে ধরে ওঠানোর জন্যও ছিল না কেউ, ছিল আমার সিকিউরিটি নিশ্চিত করার জন্য দু-তিন জন মানুষ। যখন স্টেজে উঠে দাঁড়িয়েছি ততক্ষনে শিশির, মার্ক, মহান অলরেডি স্টেজে তাদের ইন্সট্রুমেন্টস নিয়ে প্রায় রেডি হয়ে গেছে।

অডিটোরিয়ামটা খুব বেশি বড় না। কিন্তু সামনে তাকিয়ে যা বুঝলাম তিল ধরার জায়গা আজকে এখানে নেই। অন্তত ৭ হাজার মানুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে তখন। ভালবাসার চিৎকার! অদ্ভুত সব মানুষগুলোর চিৎকার! তার মাঝে দেখলাম বিশাল ‘অর্থহীন’ লেখা ব্যানার। বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলাম আরেকটা বিশাল ব্যানার যেখানে লেখা ‘Welcome Back Aurthohin’, ডান পাশে আরেকটু দূরে আরেকটা ব্যানার ‘Return of the King’!

আর পুরো অডিটোরিয়াম জুড়ে চিৎকার আর চিৎকার... সেই আমার খুব পরিচিত নামের চিৎকার, ‘অর্থহীন’!

জীবনে প্রথমবারের মত অর্থহীন নিয়ে পুরো প্ল্যান করে আসা একটা কনসার্ট করতে এসে পুরো বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম কয়েক সেকেন্ড! কি বলবো, কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ হাত উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম, তারপর চার বছরের জমে থাকা অনেক কথা সংক্ষেপে বলার জন্য মাইক্রোফোনের সামনে গিয়ে যখনি কিছু একটা বলতে গেলাম, তখন শুধু দুটো শব্দ বের হলো, ‘হ্যালো ঢাকা’।

আমাকে আপনারা সবাই স্টেজে ওঠার সাথে সাথে ভয়ংকরভাবে বোকা বানিয়ে ফেললেন! যা প্ল্যান করে এসেছিলাম, যেভাবে কনসার্ট শুরু করবো ভেবেছিলাম, যে কথাগুলো বলব ভেবেছিলাম, সেসব কিছু আপনারা ভুলিয়ে দিলেন! তারপর ঘণ্টাখানেক আমরা মনে হয় স্টেজে ছিলাম। সে সময়টুকুতে আমরা শুধু গান গাইনি। আমরা অর্থহীনের চার জনই সেই এক ঘণ্টায় সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটা কিছু এক্সস্পেরিয়েন্স করেছি। আমাদের ব্যান্ডের প্রতিটি সদস্যদের জন্য সেই ৬০ মিনিট ছিল ভয়ংকর সুন্দর একটা কিছু যেটা এই স্ট্যাটাসে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব না!

ভালবাসার গভিরতা, শক্তি অথবা ক্ষমতা এত বেশি হতে পারে? প্রতিটা মুহূর্তে মনে হচ্ছিলো চড় খাচ্ছিলাম!

ডিসেম্বরের ২৩ তারিখ, ২০২১। এই দিনটির কথা সারাজীবন অর্থহীনের প্রতিটা সদস্যের মনে থাকবে! কারণ সেদিন আমরা ঢাকার কামব্যাক কনসার্ট করেছি সে জন্য নয়। কারণ সেদিন পুরো কনসার্টটা শুরু হওয়া থেকে শেষ হওয়া পর্যন্ত আপনারা যেভাবে বারবার প্রমাণ করে দিয়েছেন আমাদের কতটা ভালবাসেন সেটা আমাদের ধারনার অনেক বাইরে ছিল! আমি শারীরিকভাবে যতদিন সুস্থ থাকবো, ততদিন অর্থহীন আপনাদের নিরাশ করবে না ইনশাআল্লাহ। অদ্ভুত সব মানুষগুলোর জয় হোক! The Phoenix has risen!’

এলএ/এমএস



Advertiser