যেদিন প্রথম বন্দুক হাতে নিয়েছিলেন, সেদিন থেকেই একটা স্বপ্নের বীজ মনের মধ্যে বপন করেছিলেন- জিততে হবে অলিম্পিক পদক। অলিম্পিক খেলা হয়েছে শারমিন আক্তার রত্নার। কিন্তু পদক জয়ের স্বপ্নটা অধরাই রয়ে গেছে। এরই মধ্যে শ্যুটিং খেলাটা ছেড়েও দিয়েছেন বাংলাদেশ আনসারের এই শ্যুটার।
খেলা ছাড়লেও শ্যুটিং কিন্ত ছাড়ছেন না রত্না। বরং প্রিয় খেলাটির সঙ্গে আরও ভালোভাবে লেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। নিজে অলিম্পিক পদক জিততে না পারলেও আগামীতে অন্যরা যাতে এমন সাফল্য দেখাতে পারে সেই স্বপ্ন নিয়ে নতুন ভূমিকায় অবতীর্ণ ৩৪ বছরের এই যুবতী। শ্যুটিংয়ে তার নতুন ভূমিকা কোচের।
২০১০ ঢাকা এসএ গেমসে স্বর্ণ জেতা শ্যুটার আরেকটি এসএ গেমস দিয়েই ইতি টেনেছেন খেলোয়াড়ি জীবনের। ২০১৯ সালে কাঠমান্ডু-পোখারা এসএ গেমসের পরই অবসরে রত্না। এখন বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের কোচ হয়ে নতুন খেলোয়াড় তৈরির কাজে নেমে পড়েছেন।
ক্যারিয়ারে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন বিদেশের মাটিতে, কোচ হিসেবেও তার অভিষেক হতে যাচ্ছে বিদেশে। আগামী ৮ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় অনুষ্ঠিতব্য আইএসএসএফ গ্র্যান্ড প্রিঁতে অংশ নেবেন ১২ শ্যুটার। সেই দলে কোচ হিসেবে যাচ্ছেন শারমিন রত্না। জাকার্তা থেকেই শুরু হবে তার নতুন ক্যারিয়ার।
খেলোয়াড়ি গন্ধটা এখনও গায়ে লেগে আছে রত্নার। যে দলটি ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছে সেখানে বেশ কয়েকজন শ্যুটারের সঙ্গে খেলার অভিজ্ঞতাও আছে তার। তাই ক্যারিয়ারের দিক বদলের এই ক্ষণটা বেশ চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে মোট ৬টি স্বর্ণজয়ী এই শ্যুটার।
চাইলে আরও খেলতে পারতেন রত্না। কিন্তু নতুনদের জায়গা ছেড়ে দিতে ও ট্রেনিং দিতে খেলোয়াড় থেকে হয়ে গেছেন কোচ। ‘জীবনে নিজের লক্ষ্য পূরণ করতে পারিনি। চেয়েছিলাম এশিয়ান গেমস ও অলিম্পিকে পদক জিততে। ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে অংশ নিয়েছি। কিন্তু কঠিন স্বপ্নটা আর পূরণ হয়নি। এখন নিজের যে মেধা আছে তা দিয়ে এমন খেলোয়াড় তৈরি করতে চাই যারা অলিম্পিকে পদক জয়ের জন্য লড়তে পারে। এখন আমার নতুন লক্ষ্য সেটাই’- বলছিলেন শারমিন আক্তার রত্না।
খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারটা কেমন সমৃদ্ধ রত্নার? ২০০৪ সালে সাভার সেনা শ্যুটিং ক্লাবের হয়ে ইন্টার ক্লাব প্রতিযোগিতা দিয়ে খেলা শুরু করেছিলেন রত্না। আর পেছনে ফিরে তাকাননি তিনি। ক্যারিয়ার শুরুর ৪ বছর পর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অভিষেক ২০০৮ সালে। তিনি অংশ নেন চীনে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় এশিয়ান এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে।
২০০৫ সালে জাতীয় জুনিয়রে স্বর্ণ জিতে নিজেকে মেলে ধরতে শুরু করেন শারমিন রত্না। ২০০৯ সালে আনসার ও ভিডিপির হয়ে প্রথম জেতেন জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণ। এক এক করে ৬টি জাতীয় স্বর্ণ নিজের ঝুলিতে রাখেন। যার মধ্যে ৪ স্বর্ণ ১০ মিটার এয়ার রাইফেলে এবং দুই স্বর্ণ ৫০ মিটার এয়ার রাইফেল থ্রি পজিশনে। এর বাইরেও ন্যাশনাল এয়ারগান চ্যাম্পিয়নশিপে ৬টি স্বর্ণ আছে তার।
আন্তর্জাতিক আসরে রত্নার প্রথম সাফল্য ধরা দেয় ২০০৮ সালে। ইন্দো-বাংলা গেমসে জেতেন স্বর্ণ। ২০০৯ সালে সাউথ এশিয়ান গেমসে পান রৌপ্য পদক। ইন্দো-বাংলা গেমসের পরের আসরেও তিনি পর ২টি স্বর্ণ। পরের বছর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ- ঘরের মাটিতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ জয়।
গত বছর থেকেই রত্না বাংলাদেশ শ্যুটিং স্পোর্ট ফেডারেশনের সঙ্গে কাজ করছেন। এ বছর ১ জানুয়ারি ফেডারেশন তাকে কোচ হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। দেড় মাসের মাথায় কোচ হিসেবে অভিষেকও হতে যাচ্ছে জাকার্তায়।
রত্নার লক্ষ্য নিজ হাতে শ্যুটার তৈরি করা। কিন্তু ফেডারেশন যদি তাকে ঐ দায়িত্ব না দিয়ে তৈরি হওয়া শ্যুটারদের ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব দেন? ‘ফেডারেশন আমাকে যে দায়িত্ব দেবে আমাকে সে দায়িত্বই পালন করতে হবে। তবে এটাও ঠিক, ফেডারেশন নতুন খেলোয়াড়ও তো তৈরি করে। আমি নিজে শ্যুটার তৈরির কাজটি পেলে তাতে আমার বেশি ভালো লাগবে। খেলোয়াড় হিসেবে যে স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি কোচ হিসেবে সেই লক্ষ্যটা পূরণ করতে চাই। বাচ্চাদের নিজের হাতে গড়ে তুলতে পারলে তাদেরকে নিজের মতো তৈরি করা যাবে। আমরা মেধা দিয়ে এমনভাবে শ্যুটার তৈরি করতে চাই যাতে তার অলিম্পিক পদক জয়ের সামর্থ্য থাকে’- বলছিলেন শারমিন আক্তার রত্না।
কোচিংয়ের চ্যালেঞ্জ কতটা? রত্নার জবাব, ‘অবশ্যই চ্যালেঞ্জ। আমি চ্যালেঞ্জ নিতেও পছন্দ করি। এটা নতুন একটা মিশন। এক সময় এই শ্যুটারদের কাছে আমি ছিলাম সিনিয়র আপু। এখন তাদের শিক্ষক। আমাকেও সে বিষয়টা মানিয়ে নিতে হবে। আগে শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবতাম। এখন সবাইকে নিয়ে ভাবতে হবে।’
শারমিন আক্তার রত্নার এক মেয়ে। নাম মাহ্নূর কাওনাঈন। বয়স ৫ বছর। মেয়েকে কি শ্যুটার বানাবেন? ‘মেয়ে কী হবে তা নির্ভর করবে মেয়ের ইচ্ছার ওপর। আমি তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবো। আমি যেমন খেলতে এসে পরিবারের সমর্থন পেয়েছি, মেয়ে যা হতে চায় আমরা সমর্থন দেবো’ বলছিলেন মাগুরার এই শ্যুটিংকন্যা।
আরআই/এসএএস/এমএস