মুসলিম বিশ্বের মহিমান্বিত মাস রমজান। এ মাস ঘিরে নানা অনুষ্ঠান আর রীতি-রেওয়াজ আছে। রোজা রাখা, ইফতারের পর তারাবির নামাজ পড়া ইত্যাদি ছাড়াও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় খুশির আমেজ। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের চেয়েও এসব রীতি সাংস্কৃতিক উদযাপন হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ভূপ্রকৃতি ঊষর মরুভূমিময় দেশ জর্দান। সেখানে কীভাবে রমজান পালিত হয়, তা জানাচ্ছেন মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
ট্রান্সজর্ডান যেভাবে জর্দান
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে জর্দান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে দেশটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে ব্রিটিশরা অঞ্চলটি দখলে নেয়। জর্দান নদীর পূর্ব তীরের ট্রান্সজর্ডান এবং পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন উভয়ই ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসে। ১৯৪৬ সালে ট্রান্সজর্ডান অংশটি একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৪৯ সালে এর নাম বদলে শুধু জর্দান (জর্ডান) রাখা হয়।
রমজানের আমেজ রাজকীয়
রাজকীয় জর্দানে রমজানের আমেজটাই ভিন্ন। জর্দানের অধিবাসীরা একটু ভিন্ন রমজান সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের চর্চা করে। জর্দানের জগদ্বিখ্যাত রমজান সংস্কৃতির একটি হলো, গোশতের শরবত। দেশি গম ও গোশত দিয়ে তৈরি করা হয় এই শরবত। রমজানে হরেক রকম কফিও তৈরি হয় আম্মানে। অতিথিদের বিভিন্ন রঙের কয়েক প্রকার কফি পরিবেশন করা জর্দানি সংস্কৃতির অংশ। রমজানে মসজিদে ইফতারের সাধারণ আয়োজনেও থাকে গরম কফি।
সৌভাগ্যের প্রতীক চাঁদ দেখা
শুধু খাদ্য-খাবারের ঐতিহ্য নয়, ইবাদত-বন্দেগি, দোয়া-জিকির এবং দান-আতিথেয়তায়ও আছে জর্দানবাসীর নিজস্ব ঐতিহ্য। আনন্দ-উল্লাসে রমজানকে গ্রহণ করে তারা। রমজানে চাঁদ দেখতে পুরুষরা পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণ করে এবং নারীরা বাড়ির ছাদে। রমজানে চাঁদ প্রথম দেখতে পারাকে তারা সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে। এমনকি যে ব্যক্তি প্রথম রমজানের চাঁদ দেখতে পায়, তার নাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। রমজান মাসে আম্মানবাসী প্রচুর দান করে। বিশেষত তারা খেজুরসহ অন্যান্য ইফতারসামগ্রী দরিদ্রের মাঝে বিতরণ করে।
বিশেষ আয়োজনের রমজান
শাবান মাসের শেষ দিক থেকেই আমলের প্রস্তুতি নেয় সবাই। তাহাজ্জুদের সময় মসজিদ খুলে দেওয়া হয়। জামাতে মুসল্লিদের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। জর্দানের প্রায় শতভাগ পুরুষই তারাবির জামাতে অংশগ্রহণ করে। জর্দানে একই মহল্লায় ভিন্ন ভিন্ন মাজহাবের একাধিক মসজিদ আছে। প্রত্যেক মসজিদের ইমাম নিজ মাজহাব অনুযায়ী তারাবির নামাজ আদায় করেন। প্রত্যেকেই অন্যের মতাদর্শকে সহনশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করে। প্রতিটি মসজিদে ফজর ও আসরের পর কোরআনের দরস হয়। এ ছাড়া মাসব্যাপী অনুষ্ঠিত হয় হিফজুল কোরআন, হিফজুল হাদিস, হামদ-নাত ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা।
খেজুর ও কফি দিয়ে ইফতার
প্রতিটি মসজিদেই ইফতারের আয়োজন করা আম্মানের সংস্কৃতির অন্যতম দিক। প্রতিটি বাড়িতে মসজিদের জন্য দানবাক্স থাকে। একজন ব্যবস্থাপক সে অর্থ সংগ্রহ করেন। মসজিদে উন্মুক্ত ইফতারের আয়োজন করেন। জর্দানবাসী খেজুর ও কফি দিয়ে ইফতার করে এবং জামাতের সঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করে। এরপর রাতের খাবার গ্রহণ করে। রাতের খাবারে তারা আম্মানি রুটি, গোশত এবং মাছ গ্রহণ করে। তারাবির নামাজ আদায় করার পর তারা পুনরায় খেজুর ও কফি খায়। এ সময় মসজিদেও মুসল্লিদের জন্য খেজুর ও কফির ব্যবস্থা করা হয়। এরপর অনেকেই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা করতে যায়।
আজানের সঙ্গে সমস্বরে সংগীত
রমজানে জর্দানিদের জীবনযাত্রা অনেকটাই স্বাভাবিক থাকে। সকালবেলা উঠে কাজে যায়। বিকেলবেলা ফেরে। আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময়টা তারা ইবাদত-বন্দেগি ও দোয়ার জন্য অবসর রাখে। ইফতারের সময়টা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে শিশুরা। তারা খেলনা ও খাবার নিয়ে আশপাশের উপত্যকায় খেলতে চলে যায়। মাগরিবের আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সমস্বরে স্থানীয় কিছু সংগীত গাইতে থাকে।
যেমন—‘উজুনুন! উজুনুন! ওয়া লুবুন! ওয়া লুবুন!’ অর্থাৎ আজান হয়েছে হে উপত্যকাবাসী! তোমরা দুধ গ্রহণ করো। ইফতার করো। এ সংগীত শুনে জর্দানবাসী ইফতার শুরু করে। আসরের পর থেকে শুরু হয় প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার বিতরণ। সবাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবেশীদের মাঝে ইফতার বিতরণ করে। অনেকেই ঘরে তৈরি ইফতার মসজিদে পাঠিয়ে দেন সবার জন্য।
মুনশি/এসইউ/এএসএম