ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সাক্ষী কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি কাপড় এখনো দেশ-বিদেশে বেশ সমাদৃত। তবে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে হাতে তৈরি খাদি। ডিজিটাল যন্ত্রপাতির কাছে হার মেনে এরইমধ্যে বন্ধ হয়েছে অধিকাংশ কারখানা। ক্রমেই ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন হাতে তৈরি খাদি কারখানার মালিকরা। আর জীবিকার তাগিদে পেশা পাল্টাচ্ছেন শ্রমিকরা। তাই ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা ও যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯২১ সালে মহাত্মা গান্ধীর আহ্বানে ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় বিদেশি পণ্য বর্জন করে দেশীয় ‘মোটা কাপড়, মোটা ভাত’ ব্যবহারের ডাক আসে। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে খাদি কাপড় বোনা শুরু হয়। এটি ছিল সেই অহিংস আন্দোলনের অন্যতম রাজনৈতিক হাতিয়ার। সেই রেশ ধরেই খাদির পুনর্জাগরণ। ওই সময় কুমিল্লার অভয়াশ্রম, চট্টগ্রামের প্রবর্তক সংঘ এবং নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমেও খাদি বোনা হতো।
১৯৩৭ সালে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার বরকামতা এলাকায় গ্রামীণ খাদি নামে প্রথম খাদির কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠা করেন শৈলেন্দ্রনাথ গুহ। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কুমিল্লা থেকে খাদি শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা প্রত্যাহার করা হলে এ শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। কিন্তু ওই বিপর্যয় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৫২ সালে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় আন্দোলনের প্রাণ পুরুষ ড. আখতার হামিদ খানের চেষ্টায় এবং তৎকালীন গভর্নর ফিরোজ খান নুনের সহযোগিতায় কুমিল্লায় ‘দি খাদি অ্যান্ড কটেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়।
শৈলেন্দ্রনাথ গুহ বরকামতার খাদির কারখানাটি ধরে রাখেন। কর্মহীন ব্যক্তিদের খুঁজে এনে তার কারখানায় সুতা কাটা, কাপড় বোনার কাজ দিতেন। সারাদেশে প্রসার ঘটাতে তিনি ঢাকায় ‘প্রবর্তন’ নামে একটি খাদি কাপড় বিক্রির দোকান চালু করেন। ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে ধীরে ধীরে খাদি কাপড়ের চাহিদা বাড়তে থাকে।
খোঁজ নিয়ে জানান, কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার মাধাইয়া, কলাগাঁও, কুটুম্বপুর, হারং, বানিয়াচং, ভোমরাকান্দি, বেলাশ্বর, মধ্যমতলা, বাড়েরা, গোবিন্দপুর, ছয়ঘড়িয়া, হাঁড়িখোলা ও দেবিদ্বার উপজেলার বরকামতা, নবীয়াবাদ, জাফরাবাদ, সাইতলা, ভাকরাবাদ, ভানী এবং মুরাদনগর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে ছোট-বড় প্রায় শতাধিক খাদি কারখানা। বর্তমানে হাতে বোনা এসব কারখানার অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গেছে। হাতে গোনা ১০ থেকে ১২টি কারখানা চালু থাকলেও উৎপাদন হচ্ছে নামমাত্র। ফলে আধুনিক মেশিনের তৈরি খাদি কাপড়ে সয়লাব বর্তমান বাজার।
কুমিল্লার বাজার ঘুরে দেখা যায়, কান্দিরপাড়ের জোসনা স্টোর, খাদি নীড়, পূর্বাশা গিফট অ্যান্ড খাদি, কুমিল্লা খদ্দর, মনোহরপুরে প্রসিদ্ধ খাদি ভাণ্ডার, বিশুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডার, আদিকালের খাদি, খাদি ভূষণ, খাদি ভবন, সৌরভ খাদি, খাদি ঘর, খাদি কুটিরশিল্প ও খাদি বিতানসহ অন্তত অর্ধশতাধিক খাদি দোকানি নানাভাবে খাদি প্রস্তুত ও সংগ্রহের মাধ্যমে কুমিল্লা খাদি শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে খাদি শিল্প মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
মনোহরপুর প্রসিদ্ধ খাদি ভাণ্ডারের স্বত্বাধিকারী সাইফুদ্দিন আহমেদ লিমন জাগো নিউজকে বলেন, খাদি কাপড়ের চাহিদা আগের থেকে অনেক বেড়েছে। তবে সে হারে উৎপাদন বাড়েনি, বরং কমেছে। বলতে গেলে সব মিলিয়ে কুমিল্লায় উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২০ শতাংশ। ফলে বাধ্য হয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মেশিনের তৈরি খাদি কাপড় এনে বিক্রি করতে হচ্ছে। বিশেষ করে মহামারি করোনায় আমরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে আমার বিশ্বাস।
খাদি ভবনের স্বত্বাধিকারী সানাই দাশগুপ্ত জাগো নিউজকে বলেন, কুমিল্লাতে যে কাপড় উৎপাদন হয় ওটাই আসল খাদি। বর্তমানে তাঁতিদের সংকট রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি ভর্তুকি পেলে তাঁতিদের আগ্রহ যেমন বাড়বে, তেমনি উৎপাদনও বাড়বে বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
বিশুদ্ধ খদ্দর ভাণ্ডারের পরিচালক নারায়ণ বলেন, ১৯৫৪ সাল থেকে আমার দাদা, বাবা বর্তমানে আমরা এ প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছি। আগের মতো ভালো নেই। কারণ যারা খাদি কাপড় তৈরি করেন তারা সঠিক মজুরি পাচ্ছেন না। ফলে মালামালও তৈরি হচ্ছে খুব সীমিত আকারে। যা দিয়ে বাজারে টিকে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। যে কারণে বর্তমানে খাদির সঙ্গে অন্যান্য কাপড় তুলে আমাদের বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, আমাদের সহযোগিতা করা হোক, যেন শতবছরের ঐতিহ্য কুমিল্লার খাদিশিল্পকে ধরে রাখতে পারি।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছেন ফরিদ আহমেদ নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি ঈদেই কুমিল্লার বিখ্যাত খাদির একটি আইটেম আমি কিনে থাকি। আমি মনে করি, খাদির মানোন্নয়নে আরও এক্সপার্টের প্রয়োজন আছে। ট্রেক্সটাইল বিষয়ে যাদের ডিগ্রি আছে, তাদের সম্পৃক্ত করে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আরও উন্নত করতে পারলেই কুমিল্লার ঐতিহ্য আরও হাজার বছর টিকে থাকবে।
এস এন ইউসুফ নামে এক ক্রেতা জাগো নিউজকে বলেন, কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী খাদি এখন খুব একটা পাওয়া যায় না। কারণ বাজারে যে সমস্ত কাপড় কুমিল্লার খাদি নামে বিক্রি হচ্ছে এর সিংহ ভাগই কুমিল্লার বাইরে থেকে আসা। এর কারণ হিসেবে যতটুকু জেনেছি লোকসানে পড়ে অধিকাংশ মালিক ও কারিগররা পেশা পরিবর্তন করেছেন। সঠিকভাবে সরকার তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করলে খাদির ঐতিহ্য আবার ফেরানো সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ খদ্দর ভাণ্ডার কারখানার স্বত্বাধিকারী রঞ্জিত দেবনাথ জাগো নিউজকে বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁতিরা বিলীন হয়ে গেছে। কুমিল্লায় বর্তমানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাত্র ১০টি কারখানায় খাদি কাপড় উৎপাদন হচ্ছে, তাও সীমিত আকারে। উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় বাজারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টেকা যাচ্ছে না। সরকারিভাবে এ ঐতিহ্যকে ধরে না রাখলে একদিন এ শিল্পটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, খাদি কুমিল্লার ব্র্যান্ডিংয়ের একটি অংশ। জেলাজুড়ে খাদি উৎপাদন নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের একটি তালিকা করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প হিসেবে তাদের প্রণোদনা ও ব্যাংক ঋণসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করবো। আমি চাইবো কুমিল্লার এ ইতিহাস-ঐতিহ্য চালু থাকুক এবং মানুষ খাদি কাপড় পরিধান করুক।
এমআরআর/জিকেএস