বিকেল সাড়ে ৫টা, দিনাজপুর জেলার প্রাণকেন্দ্র পুলহাট থেকে একটি রাস্তা সোজা দক্ষিণ দিক হয়ে রামসাগরের দিকে গেছে। পুলহাট পেরিয়ে খানিকদূর গেলেই পাওয়া যাবে মাসিমপুর এলাকা। মাসিমপুর এলাকার প্রধান রাস্তা দিয়ে গেলেই রাস্তার দুই পাশে দেখা মিলবে কিছু লিচু ব্যবসায়ীর। যারা সবাই নারী ও শিশু।
প্রতিদিন সকালে স্কুল যাওয়ার আগে বাগান থেকে কুড়িয়ে রাখা লিচু বিকেলে বিক্রি করে শিশুরা। তাদের সহযোগিতা করেন তাদের মা, বোন ও দাদিরা। রাস্তার ধারে এই দৃশ্য দেখলেই মানুষ ধরে নেয় দিনাজপুরে লিচু উৎসব শুরু হয়ে গেছে।
বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সিলেবাসের পাঠ চুকিয়ে এখানে লিচু ব্যবসায় মেতে ওঠে শিশুরা। চোখে না দেখলে এই দৃশ্য কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। তিন কিলোমিটার জুড়ে থেমে থেমে মিলবে এমন লিচু বিক্রির দৃশ্য।
শুধু মাসিমপুর এলাকাই নয়, সদর উপজেলার শেষ সীমানা মাদারগঞ্জ হাটের পূর্বেও এমন চিত্রের দেখা মিলছে। শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা লিচুর মৌসুমে অনেক ভোরে উঠে বেরিয়ে পড়ে লিচু সংগ্রহ করতে। যে বাগানেই লিচু ভাঙা হবে সেই বাগানেই তারা পৌঁছে যায় লিচু কুড়াতে। যথারীতি লিচু কুড়িয়ে তারা জমিয়ে রাখে। এরপর চলে যায় বিদ্যালয়ে।
বিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময় শেষ হয় বিকেল ৪টায়। তারপর সকালের কুড়িয়ে রাখা লিচুগুলো আর কয়েকটি বাটি নিয়ে চলে আসে রাস্তার পাশে। কুড়িয়ে আনা লিচু বাছাই করে তা বাটিতে সাজিয়ে রাখে। উদ্দেশ্য বিক্রি করা। তাদের ওই লিচুর মূল্য প্রতি বাটি জাত ভেদে ১৫, ২০, ৩০ ও ৫০ টাকা।
তাদের সাজিয়ে রাখা লিচুগুলোর ক্রেতা রাস্তার পথচারীরাই। তাদের এই ব্যবসা চলবে এক মাস।
শিশুরা জানায়, লিচু বিক্রির টাকায় কারও ইচ্ছা হাতঘড়ি কেনার, কারও বা পোশাক, কেউবা আবার টিফিনে খাবে পছন্দের খাবার। আবার কারও স্বপ্ন রয়েছে স্মার্ট মোবাইল ফোন ও বাই সাইকেল কেনার।
তেমনই একজন লিচু বিক্রেতা রাকিব। সে মাসিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। কথা হয় তার সঙ্গে। সে জানায়, সকালে যখন বাগানে লিচু ভাঙা হচ্ছিল তখন লিচুগুলো কুড়িয়ে রেখেছিল। বিকেলে স্কুল ছুটি শেষে বাড়ি না গিয়ে এখানে চলে এসেছে। আমার চাচি আমার কুড়িয়ে রাখা লিচুগুলো এখানে নিয়ে এসেছে। এই লিচুগুলো বিক্রি করে আমি আমার পছন্দের একটি সাইকেল কিনব।
জাহিদ নামে আরেক শিশু জানায়, লিচুগুলো বাগান থেকে সংগ্রহ করেছি। সকালে পড়ার চাপ ও প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার কারণে বাগানে যেতে পারিনি। বিকেলে স্কুল থেকে এসে কুড়িয়েছি। এই লিচুগুলো আমি ১৫ টাকা করে বাটি বিক্রি করছি। লিচুগুলো কুড়ালে বাগান মালিকরা কিছু বলেন না। আমি লিচুগুলো বিক্রি করে আমার পছন্দের জামা কাপড় কিনব।
চেরাডাঙ্গি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান জানায়, স্কুল শেষে এখানে লিচু বিক্রি করতে এসেছে সে। লিচুগুলো সকালে কুড়িয়ে রেখেছিল। রাস্তা দিয়ে পথচারী যাওয়া আসা করে, লিচুগুলো দেখে পছন্দ হলে তারা কিনে নেয়। এই লিচু বিক্রির টাকা দিয়ে একটি মোবাইল ফোন কেনার স্বপ্ন তার।
আমিনা বেগমের বয়স ৫০ পেরিয়েছে। নাতি আরমানকে রাস্তার ধারে লিচু বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘নাতিটা ভোরে উঠি লিচু কুড়াইছে মাইসের বাগানত। লিচু বিকি করি ব্যাগ কিনিবি। সেই তোনে মুই আইছ নাতিটার সঙ্গে।’
পাশে রাস্তার ধারে মা মৌসুমি নিজের বাগান থেকে ছেলের কুড়ানো লিচু বিক্রি করছেন। ছেলেকে স্কুল থেকে আসার পর প্রাইভেটে পাঠিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বেটাটা সকালে হামার নিজের বাগানত লিচু পাড়ার সময় ঝুটা লিচু কুড়াইছে। লিচু বেচিবার তনে প্রাইভেটত যাবেনাই। পড়া কামাই করিবি। সেই তনে বিক্রি করি দেছু বাহে।’
এলাকার যুবক মোসাদ্দেক হোসেন বলেন, এটা প্রতিবছরের চিত্র। আমরা আগে দেখতাম আমন ধান কাটার সময় শিশুরা ইদুরের গর্ত থেকে ধান সংগ্রহ করত। আবার ধানের ভেঙে পড়া শীষ কুড়িয়ে ধান সংগ্রহ করত। সেই ধান বিক্রি করে নতুন জামা কিনত, মেলায় বেড়াতে যেত, বই খাত কিনত। সেই দৃশ্য এখন দেখা ভার। এখন শিশুরা আনন্দের সঙ্গে ঝরে পড়া বা ঝুট লিচু কুড়িয়ে রাস্তার ধারে বিক্রি করছে। এই দৃশ্য সেই শৈশবকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। দেখে মনে হয় লিচু উৎসব দেখতে হলে মাসিমুপর থেকে রামসাগর দিঘির এই রাস্তাতেই যেতে হবে।
এফএ/এমএস