রবিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২

‘তবুও নিচতারার দুঃখ ছিল না’

প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো, সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকানো। চোখ রাঙিয়ে তর্জন-গর্জন করছে। ধমক দিচ্ছে যেন বারবার। লাবণ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে ভাবছে কি ভুল।

কি হলো যে এত ধমকাচ্ছে! যাক তবু ভালো বৃষ্টি আসেনি। নিচতারা ঠিকমতো পৌঁছিয়ে গেলেই হয়। বাসাতো বেশি দূরেও না। আজকে আবার তাকে দেখতে আসবে, কেন যে থেকে গেলো না।

আখতারুন্নেচ্ছা খাওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে উঠান পেরিয়ে দালানে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখতেই দেখতে পেলেন লাবণ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশপানে চেয়ে আছে।

কি যে সুন্দর নিষ্পাপ একটা মুখ, তার শাশুড়িকে তিনি দেখেননি। কিন্ত চেয়ারম্যানের মুখে শুনেছেন তার মেয়েরা কেউ নাকি তাদের দাদির মতো হয়নি। কিন্তু লাবণ্য নাকি অনেকখানি।

মাশাআল্লাহ, বলতে বলতে সিঁড়ির ধাপ শেষ করে লাবণ্যর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, কিরে খাবি না? তোকে ডাকতে আসলাম।

হ্যাঁ নানু চলো...
এসব বিড় বিড় করে কি বলছো?

আয়াতুল কুরসী পড়ে লাবণ্যর গায়ে ফুঁ দিয়ে বললেন, কিছু না, গ্রাম দেশে আসছিস, শহরের মেয়ে। এদিকে কতকিছু থাকে, বদ নজর না লাগুক।

তুমিও নানু...

এসব জিন-ভূত বিশ্বাস করো?

নজর লাগলে মানুষের নজর লাগে, জিনের না

সবারই লাগে ময়না, জিনও আছে; বদ নজর দেওয়ার মানুষও আছে। আল্লাহপাক জিন ও ইনসানকে তার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করছেন।

হ্যাঁ, জিন সব গ্রামেই আছে, ঢাকা, ইউরোপ, আমেরিকায় আমি কখনই জিনের গল্প শুনিনি।

শুনিস নাই, কিন্তু শোনার সময় চলেও যায়নি, কতইবা বয়স তোর, সবকিছুই সময়মাফিক হয়। তোর বয়সে মনে হয় আমিও শুনি নাই।

আচ্ছা নানু; নিচতারাকে এই বাসায় রেখে দাও না কেন? রোজ রাতে যাওয়ার কি দরকার, থেকে গেলে তোমার কাজের সুবিধা হয় না?

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন আখতারুন্নেচ্ছা,
বললেন আরও বড় হ, তারপরে বুঝবি।

আহা, (আমি তো বড় হয়ে গেছি) https://ift.tt/ZnXvcK6, খালি বয়স বাড়লে বা লম্বা হলেই মানুষ বড় হয় না, যে যত বেশি ঝামেলা আর কষ্টের মধ্যে দিয়ে যায় সে তত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যায়।

আখতারুন্নেচ্ছা মৃদু হেসে লাবণ্যর কাঁধে হাত রাখলো।

শোন, এই বাড়িতে তোর নানা আর আমি ছাড়া কেউ থাকে না, রাশেদ ভার্সিটির হোস্টেলে থাকে। এখন ছুটি বলে আছে। বাকি ছেলেমেয়েরা যার যার সময় সুযোগমতো আসে। সেজন্য বৈঠকখানার ঘরে রাতে পিন্টু থাকে। এমনকি মাঝে মাঝে মন্টুও থাকে। রায়হান, রিতা, মিতা সবাই পিন্টুকে থাকতে বলছে যেহেতু আমরা একা থাকি। রাত-বিরাতে কেউ অসুস্থ হলে পিন্টুই ভরসা, সে একটা জোয়ান ছেলে।

নিচতারাও জোয়ান মেয়ে, তাকে কেমনে রাতে থাকতে বলি বল?

পরে কিছু একটা এরেম প্রেমের ঘটনা ঘটলে জমিদার বাড়ির দুর্নাম হবে।

ওহ আচ্ছা, কিন্ত নিচতারার মা টা তো ভালো না। অনেক লোভী, ওকে টাকার জন্য একটা বুড়া লোকের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়।

হ্যাঁ, সে একটু অন্যরকম জানি। কিন্তু আমাদের সাহায্য ছাড়া তো মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে না। অনেক গরিব ওরা। তু্ই চিন্তা করিস না। আমি দেখবোনি। এখন চল তো খেতে। সেই কখন বেলা থাকতে খাছিস। খিদা লাগেনি?

হুম চলো
বৃষ্টি এলো তো... চলো ভিজি আমরা দু’জন
বড় ফোটার বৃষ্টি শুরু হলো ঝমঝমিয়ে...

না না, ভিজিস না, ঠান্ডা লেগে জ্বর আসবে
আমি কিন্তু মামার সঙ্গে মাছ ধরতে যাবো।

তোর মা চিল্লাবে...
সে তো সবসময়েই চিল্লায়। এ কি নতুন কিছু!

আমি পারলে তোকে আমার কাছে রেখে দিতাম,
কিন্তু তোর বাবা রাজি হবে না।

দু’জনেই মাথায় কাপড় দিয়ে খাওয়ার ঘরের দিকে যেতে যেতে লাবণ্য বললো কেউই রাজি হবে না নানু।

নিচতারা তার বাসায় গিয়ে দেখে তার মা’র মুখ বেশ হাসিখুশী। নিচতারাকে দেখে বললো তাড়াতাড়ি ডুব দিয়ে চকিতে রাখা শাড়িটা পরে আয়। তোকে দেখতে আসবে।

বলেই রান্নাঘরে চলে গেলো....

নিচতারা কি বলবে বুঝতে পারছে না।
টাকার অভাবে পড়াশোনা বন্ধ করে মানুষের বাসায় কাজ নিতে হইছে। মেয়ে হয়ে সংসারের হাল ধরতে হইছে দুই বোনের। তবুও দুঃখ ছিল না।

কিন্তু এখন তো জীবনও দিয়ে দিতে হবে...
কিছুতেই সে উপরওয়ালার হিসাব বুঝলো না, এত মানুষ থাকতে তার বাপেরই কেন পঙ্গু হতে হলো!
তা না হলে তো আজ আর তার এই দুর্গতি হতো না।
এখন কি যে হবে।

এদিকে রাশেদ তার সব সরঞ্জাম গুছিয়ে ফেলছে,
হারিকেন আর টর্চ সাথে নিলো।

অরণ্য জিজ্ঞাসা করলো
মামা হ্যাজাক নেবে না?

নাহ, বেশি আলোতে মাছ উঠবে না
মিন্টু, পিন্টু অরণ্য রেডি...

লাবণ্য আসফাকউদ্দীনের বিছানায় তার নানার পাশে শুয়ে আছে গাল ফুলিয়ে। কেঁদে কুটে চোখ লাল।
রিতা তাকে মাছ ধরতে যেতে দেয়নি।

এটা নিয়ে এক পশলা ঝগড়া হয়ে গেছে রিতার সঙ্গে নানা-নানুর। সে রাতের বেলা মেয়েকে বাইরে যেতে দেবে না মাছ ধরতে।

আসফাকউদ্দীন এবং আখতারুন্নেচ্ছা দুজনেরই মুখ বেশ থমথমে।
রায়হান একটু আগে বিদায় নিয়ে চলে গেছে, বলে গেলো শারমিন তিন মাসের গর্ভবতী, তাই আনেনি এবার।

ওদিকে নিতুর স্বামী জাকির এসে খাওয়া দাওয়া করে নিতুকে নিয়ে চলে গেছে। জামাইটা অতটা পদের হয়নি। সারাক্ষণ চিন্তা শশুরবাড়ির সম্পত্তির দিকে। সরাসরি কিছু বলে না, কিন্তু ইনিয়ে বিনিয়ে এটা সেটা বলতেই থাকে।

নিতুর যাওয়ার সময়ে বেশ মন খারাপ ছিল। লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে ছিল অনেকক্ষণ। চোখের পানি মুছতে মুছতে গেছে।

রাশেদ বেরিয়ে গেলো মাছ ধরতে অরণ্য পিন্টু, মন্টুকে নিয়ে।
রাশেদেরও মন বেশ খারাপ, মেয়েটা এত শখ করে ছিল মাছ ধরতে যাবে।
বড়পার চিকিৎসা দরকার, ভয়ানক অসুস্থ।

আখতারুন্নেচ্ছা বললেন, বেশি রাত করিস না রাশেদ। তাড়াতাড়ি চলে আসিস। অরণ্য আছে সঙ্গে। মন্টু তু্ই অরণ্যর সাথে সাথে থাকবি সবসময়।

রিতা অন্য ঘরে...
আখতারুন্নেচ্ছা সেদিকে পা বাড়ালেন।

নানা, তুমি তমিজ নানার চোখের ছানি কাটার ব্যবস্থা করে দিও তো। তিনি চোখে সব কিছুই ঝাপসা দেখে।
আচ্ছা তু্ই যখন বলছিস করব। তু্ই তমিজ কবিরাজকে কই পাইলি?

সকালে বিলের ধারে গিয়েছিলাম রাশেদ মামার সঙ্গে। তখন দেখা হয়েছিল...

কি বললো?

কি আর বলবে, ঝাঁপসা চোখেই আমাকে দেখে বললো ‘বেগম আম্মা’

তাহলে আবার চোখে ছানি পড়লো কই...
লাবণ্য হেসে বললো মজা করো?

আসফাকউদ্দীন হেসে বললেন করলাম না হয় একটু,
তোর সাথেই তো... কত বছর আম্মাকে দেখি না, তোকে দেখলে মনে পড়ে।
আচ্ছা; এবার ঠিকমতো বলতো, রিতা কি বাসাতেও তোর সাথে এমন করে?

লাবণ্যর হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তেই ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।
বললো বাসায় আরো বেশি করে...

আমি একটা আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন জেলখানায় থাকি বলতে পারো যেখানে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার সুব্যবস্থা আছে, কিন্তু আর কিছু নাই, একদমই নাই।

দুনিয়ার ঘুম পাচ্ছে নানা, গতকাল ঘুম হয়নি।
আমি আজকে তোমাদের ঘরে ঘুমাবো, আম্মুর সাথে ঘুমালে পুরো রাত লেকচার শুনতে হবে।

আচ্ছা ঘুমা...

আসফাকউদ্দীনকে বেশ চিন্তিত দেখালো, রিতাকে কোনো কথা বোঝানোই যাচ্ছে না, নিতুর জামাই আর এক সমস্যা।
রায়হানের ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না।

মিতার সঙ্গে কথা বলতে হবে, ওর মাথাতেই ঠিকঠাক বুদ্ধি আছে, আর রাশেদের।

লাবণ্যর দিকে তাকালো, ঘুমিয়ে গেছে।
কি যে মায়াবতী, সুবহান আল্লাহ।

পাশের ঘরে রিতা আর আখতারুন্নেচ্ছা কথার শব্দ কানে এলো।
আসফাকউদ্দীন কোনো কথা না বলে ভাবতে লাগলেন, বড় জামাইকে ডাকতে হবে অথবা ঢাকায় যেতে হবে দুদিন সময় বের করে।

বেশ হৈ চৈ আর শোরগলে ঘুম ভাঙলো লাবণ্যর।
অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে...
চারপাশে আলো ফুটে গেছে
কিন্তু সবাই উঠে গেছে কেন এতো আগেই
নাকি অনেক বেলা, কিছুই তেমন বুঝে উঠতে পারছে না,
উঠে বসলো বিছানায়...

বাইরে থেকে আসফাকউদ্দীনের গলা কানে আসছে...

লাবণ্যকে উঠতে দেখে আখতারুন্নেচ্ছা এসে পেছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন।
কি হয়েছে নানু?

রিতার গলা, এখন তো জমিদার বাড়ির দোষ হবে,
মানুষতো নানা রকমের গল্প বানাবে।

রাশেদকে দেখে লাবণ্য বলে উঠলো
কি কি মাছ পেয়েছো মামা? আমি এমন ঘুম দিয়েছিলাম, বুঝতেই পারিনি কখন এসেছো...
এখন কয়টা বাজে?

৮টা...

কতগুলো মাছ পেলে বললে না?

হঠাৎ লাবণ্য খেয়াল করলো তার হাতে পানির ফোটা
আখতারুন্নেচ্ছার চোখ থেকে!

কি হয়েছে নানু কথা বলছো না কেন...
আখতারুন্নেচ্ছা লাবণ্যকে শক্ত করে ধরে আছে।

আসফাকউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে পুলিশ কথা বলছে বাইরে।
নানু, মামা, আম্মু কি হয়েছে?

রিতা বললো

‘নিচতারাকে ভোরবেলা বিলের পানিতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছে।’

এমআরএম/জেআইএম



Advertiser