রবিবার, ৮ জানুয়ারী, ২০২৩

আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বিদ্রোহী

আসন্ন উপ-নির্বাচনে বগুড়া-৬ (সদর) আসন থেকে নৌকার জয় রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ আসনটিতে জয় পাওয়ার চেষ্টা ছিল বহুদিন থেকে। কিন্তু ৪৩ বছর ধরে সেটি সম্ভব হয়ে ওঠেনি। এবার বিএনপি মাঠে না নেই। এরপরও আওয়ামী লীগ প্রার্থী রাগিবুল আহসান রিপুর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে মাঠে আছেন দলের সাবেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুল মান্নান আকন্দ।

বিগত পৌরসভা ও জেলা পরিষদ নির্বাচনে মান্নান দেখিয়েছেন তার ভোট ব্যাংকের কারিশমা। ফলে এবার বিএনপি না থাকলেও নৌকার প্রার্থীকে ঘাম ঝরাতে হবে।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, প্রার্থী সিলেকশনে ভুল করা, দলীয় কোন্দলসহ শরীকদের কাছে আসন ছেড়ে দেওয়ায় নৌকা দীর্ঘ সময় ধরে পিছিয়ে আছে। এবার হবে নৌকার প্রেসটিজিয়াস খেলা। তবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ থাকায় এ আসনে নৌকার জয় নিয়ে অনেকেই সন্দিহান আছেন।

আব্দুল মান্নান আকন্দ আগে বগুড়া পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরে দল থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এ অবস্থায় তিনি বগুড়া পৌরসভার নির্বাচনে অংশ নেন। অল্প সময়ের মধ্যে বগুড়া পৌরসভায় মেয়র পদে এবং জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন।

রাজনৈতিক দলের বাইরে থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করেন ধানের শীষ ও নৌকার প্রার্থীর বিরুদ্ধে। মেয়র পদে দাঁড়িয়ে ৫৬ হাজার ভোট পেয়ে তাক লাগিয়ে দেন বগুড়ার রাজনৈতিক মহলে। এ ভোটে বিএনপি প্রার্থী রেজাউল করিম বাদশা জিতলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী ওবাইদুল হাসান ববির জামানত বাতিল হয়।

এরপর মান্নান আকন্দ ভোট যুদ্ধ করেন জেলা পরিষদ নির্বাচনে। সেখানেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর প্রতিপক্ষ হন তিনি। এ সময় সরকারি দলের নেতারা অনুরোধ করে তাকে ভোট থেকে সরাতে ব্যর্থ হন। পরে একটি মামলায় কারাভোগ করতে হয় তাকে। পুরো নির্বাচনকালে তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন। এরপরও অল্প ব্যবধানে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে হার মানতে হয় তাকে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেওয়ায় ২০১৯ সালের ২৪ জুনের উপ-নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী হন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ। তিনি ৮৯ হাজার ৭৪২ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জেলা শাখার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক টি জামান নিকেতা পেয়েছিলেন ৩২ হাজার ২৯৭ ভোট। এবার নিকেতাকে বাদ দিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগিবুল আহসান রিপুকে।

এলাকার ভোটার এবং সাধারণ মানুষ বলছেন, মান্নান আকন্দ অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে পৌরসভা এবং জেলা পরিষদেও নির্বাচন করেছেন। সেখানে তিনি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন। এবার উপ-নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন। এটা আওয়ামী শিবিরে শুধু আলোচনায় নয়, বরং ভীতি হিসেবে দেখা দিয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বগুড়া সদরের এই প্রেসটিজিয়াস আসনটি বিগত ৪৩ বছর আওয়ামী লীগের হাতছাড়া আছে। এটি বরাবরই বিএনপির দখলে থাকে। তবে আওয়ামী লীগের না পাওয়ার কারণ হিসেবে প্রার্থী নির্বাচন ভুল, নেতাকর্মীদের বিরোধ ও অনীহা, হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্যসহ নানা কারণ উল্লেখযোগ্য। শেষের দিকে এ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির দখলে ছিল।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সর্বোচ্চ সাড়ে ৭৪ হাজার ৭০০ ভোট পেয়ে রেকর্ড গড়েন। এ সময় জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মমতাজ উদ্দিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে। এরপর গত ১৫ বছরের ব্যবধানে অর্ধেকের বেশিতে নেমে এসেছে নৌকার ভোট। বিগত সময়গুলোতে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা নির্বাচনে এর প্রমাণ মেলে।

এবার মনোনয়ন প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলেন, জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে প্রথম থেকে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন রাগিবুল আহসান রিপু। এ কারণে বিভিন্ন সময় নেতাকর্মীরা বিভিন্ন ফোরামে তার সমালোচনা করেন।

অন্যদিকে আব্দুল মান্নান আকন্দর ব্যাপারেও একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা অভিযোগ করেন। তারা বলেন, মান্নান আগে মেলা (বাণিজ্য মেলা) করতেন, জুয়ার আসর চালাতেন। তার এ কাজে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাই সে সময় সমর্থন দিয়েছেন। এখন মান্নান সমাজ সেবক হয়েছেন। বিভিন্ন দুর্যোগ ছাড়াও সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের খাদ্য এবং পড়ালেখার সামগ্রী সহায়তা করে তিনি লাইম লাইটে আসেন।

তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, আমরা চাই নৌকা জিতুক। নৌকা প্রার্থীর হয়ে কাজ করি। কিন্তু ভেতরের অবস্থা খুবই নাজুক। নেতাকর্মী ও জনগণের সঙ্গে রিপুর সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। ২০১৩ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত এখানে ১১টি ইউনিয়নের ৯৬টি ওয়ার্ডে কোনো সম্মেলন হয়নি। শুধু লোক দেখানো সম্মেলন করা হয়েছে সদর উপজেলার সাবগ্রাম, গোকুল ও রাজাপুর ইউনিয়নে। একটি পৌরসভার ২১টি ওয়ার্ডেও এখনো সম্মেলন হয়নি। এছাড়া শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তিন বছর পার হয়েছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়নি। সদর আওয়ামী লীগেরও একই অবস্থা।

নির্বাচন প্রসঙ্গে রাগিবুল আহসান রিপু জাগো নিউজকে বলেন, আমি ভোটের মাঠে আছি। নেতাকর্মীদের ভালো সাড়া পাচ্ছি। আমরা এবার বগুড়া-৬ আসনটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দিতে চাই।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের মধ্যে কোনো বিভেদ নেই। কোনো দ্বন্দ্ব নেই। আমরা মানুষের মন জয় করে ভোট নিতে চাই। আর বগুড়ার মানুষ উন্নয়নের স্বার্থে নৌকাকে ভোট দেবে বলে বিশ্বাস করি।

তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা আব্দুল মান্নান আকন্দ জাগো নিউজকে বলেন, আমি শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকবো। সাধারণ মানুষ আমাকে চায় এটা বিগত সময় বুঝিয়ে দিয়েছে। এখন আমি কোনো সমঝোতা করে মানুষের মন ভাঙতে চাই না। বর্তমানে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগে করুণ অবস্থা চলছে।

নৌকার প্রার্থী সম্পর্কে তিনি বলেন, যিনি দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছেন, তার কাছ থেকে একটি আসনের মানুষ কীভাবে কোনো কিছুর প্রত্যাশা করবে।

এসজে/এমএস



Advertiser