শনিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩

‘তোমার চোখে’

দুবাই এয়ারপোর্ট। মধ্যরাত, তেমন একটা ভিড় নেই, কিছু উড়ালপক্ষীর ওঠানামা আর যাত্রীদের ছুটোছুটি, শুধু ট্রানজিটের যাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এদিক-সেদিক বসে আছে।

রিহান এগোচ্ছিল হাতে ল্যাপটপের ব্যাগ, ঠিক উল্টাপাশ থেকে একটা মেয়ে হ্যান্ড লাগেজ এক হাতে, অন্য হাতে পাসপোর্টসহ কাগজ মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ করে মুখটা উঁচু করে তাকালো, সম্ভবত এয়ারপোর্টের গেট নম্বর খুঁজছে।

সেদিকে নজর যেতেই রিহানের হৃদপিন্ড মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো, মুখ দিয়ে শব্দও বের হচ্ছে না, ঠোঁট দিয়ে বিড় বিড় করে শুধু বললো অর্পা!

মেয়েটা এগিয়ে আসছে..., এক্ষুনি রিহানকে অতিক্রম করে চলে যাবে, রিহান কি কিছু বলতে পারবে? কিন্তু বলতে যে হবেই, গলার সর্বোচ্চ স্বর দিয়ে রিহান বললো, অর্পা তুমি অর্পা তাই না?

অর্পা প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছিলো রিহানকে, নিজের নাম শুনে থমকে দাঁড়ালো, মাথা ঘুরিয়ে সেই চিরচেনা জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে বললো...সরি, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে ঠিক চিনতে পারছি না...

আমি রিহান, বলেই হেসে ফেললো রিহান

অর্পাও মুহূর্তে থমকে গেলো, সেই হাসি...
কণ্ঠস্বর এক স্কেল উঁচুতে নিয়ে বলে উঠলো, আরেহ তুমি! চেহারা এমন জঙ্গল বানিয়ে ফেললে চেনা যায়?
কত্ত দিন পর...

হাজার হাজার দিন পর, রিহান হাসি মুখে বললো

দুজনের মুখই বেশ হাসি হাসি

প্রায় ঘণ্টাখানেক দুজনের কুশলাদি আর নানান গল্প শেষে এয়ারপোর্টের স্বচ্ছ কাঁচের দেওয়াল ঘেরা কর্নারে একটা ছোট টেবিলের দুপাশের দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসা দুজন। দুজনের সামনে দুটো কফির মগ, কেউ কোনো কথা বলছে না...

অর্পা কাঁচের দেওয়ালের বাইরে তাকিয়ে হুটহাট করে আছড়ে নেমে পড়া উড়ালপক্ষীদের উঠানামা দেখছে, আসলেই কি দেখছে নাকি দৃষ্টি সরিয়ে দূরের কিছু ভাবছে। ভাবছে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল রিহানের সঙ্গে কেমন ছিলো সেদিন, বড্ড অভিমান হয়েছিলো...

রিহান খুব মনোযোগ দিয়ে অর্পাকে দেখছে...

তুমি একটুও বদলাওনি অর্পা,
ঠিক পঁচিশ বছর আগের মতোই আছো।

অর্পা মৃদু হেসে কফির মগ হাতে নিলো, একটা চুমুক দিয়ে বললো, হয়তো ‘তোমার চোখে’
কিন্তু অনেকের কাছেই আমি অনেক বদলে গিয়েছি,
আমার নিজের কাছেও।

উহু, একটুও না,
সেই আগের মতোই, কত্ত বছর আগের কথা...
ভাবতেও অবাক লাগে!

হুম, ২৫ বছর।

রিহান কফির মগে চুমুক দেওয়ার আগেই হেসে বললো,
তখন আমাদের বয়সই বা কত ছিল!

১৪ পনেরো হবে,
ইসস..., সময় কিভাবে দৌড়ায়,
তুমি কিন্তু বেশ বদলেছো রিহান, তোমার হাসি না দেখলে আমি ভাবতাম এ আবার কোনো উটকো ঝামেলা এসে জুটলো যাত্রা পথে..

হুম, আমি বদলেছি ঠিক, কিন্তু তুমি না। এত্ত বছর বাদেও দেখো আমি তোমাকে ঠিকই চিনতে পেরেছি,
ভাগ্গিস এমনই ছিলে...

তাতে লাভটা কি হয়েছে শুনি?

স্বপ্নভঙ্গ হলো না।

হাসি হাসি মুখে অর্পা রিহানের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, এখনো স্বপ্ন দেখো?

হুম, দেখি বলেই তো বেঁচে আছি, স্বপ্ন ছিলো বলেই তো আজ তোমার দেখা পেলাম, জানতাম একদিন দেখা হবে, হতেই হবে। শুধু জানতাম না কবে...

তোমার ট্রানজিট কয়ঘণ্টা?

চার ঘণ্টা, কথা এড়িয়ে যাচ্ছো?

আমার তিন ঘণ্টা, এড়িয়ে যাইনি, ভাবছি তোমার একঘণ্টা একা বসে থাকতে হবে।

এই দিনটার জন্য আমি পঁচিশ বছর ধরে অপেক্ষা করছি,
আর তুমি একঘণ্টা নিয়ে ভাবছো!
তোমাকে যে আমি কত খুঁজেছি...

কেন?

রিহান হো হো করে হেসে ফেললো অর্পার দিকে তাকিয়ে,
সেইদিন অমন রাগ করে চলে গেলে, আর ফিরেও তাকালে না, তোমার কোনো ঠিকানা জানি না, না ফোন নম্বর। ওই আমলে মোবাইলও ছিল না, ফেসবুক ও না, আচ্ছা এখন তোমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে?

হুম, আছে

কোন নামে ?

আমার নামে।

তাহলে আমি খুঁজে পাইনি কেন তোমাকে?

সে তুমি জানো...

নাহ জানি না, স্রষ্টার খেলা বুঝি না...
উঁনি যে কি
এখন তোমার চেহারায় একটু কাঠিন্য এসেছে তবে লাবণ্য কমেনি একটুও, দুয়ে মিলে দারুন ব্যক্তিত্ব।

তুমি এতো বদলালে কিভাবে?

তোমার অভাবে...

অর্পা হেসে দিলো, স্বভাব তো দেখছি আগের মতোই আছে, কি ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়েছিলে! মনে আছে?

ও কি আর বদলায়?

কারো কারো তো বদলায়,
আমার চেহারা হয়তো বদলায়নি তেমন, তবে আমি বদলে গেছি, তুমি বদলাওনি তবে তোমার চেহারা বদলে গেছে বা চাপা পড়ে গেছে দাড়িগোফের আড়ালে...

নাহ, তুমিও বদলাওনি অর্পা,
কাঠিন্যর চাদর পরে থাকো শুধু।

থাকলাম না হয়..

কথার পৃষ্ঠে কথা বলতে বেশ দক্ষ এখন, আগে তো কথাই বলতে না।

পঁচিশ বছর কি দক্ষ হওয়ার জন্য কম মনে হয়?

একটুও কম না, অনেক লম্বা...
কেউ কেউ তো এত বছর বাঁচেও না,
আর আমি অপেক্ষা করেছি, তোমাকে দেখার অপেক্ষা,
না বলা কথা বলার অপেক্ষা...
তোমাকে একটা কথা বলা খুব প্রয়োজন

বলো...

শোনো মেয়ে,
মুখে বলা হয়নি,
বলতে চেয়েছি ভালোবাসি
মেলা দেরি হলো বলতে
তবু তো হলো মন্দ কি...

অর্পার চোখ ছলছল, ঠোঁটের কিনারে মৃদু হাসি...

এই তুমি কি পঁচিশ বছর আগের তুমি!
তখন কি বলেছিলে ভুলে গেছো?

আমি কি জানতাম তুমি এভাবে হারিয়ে যাবে, কত খুঁজলাম, একদম নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে, তোমার সঙ্গে আমার প্রেম ছিল না, কিন্তু তুমি হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে শূন্যতা, আজ অবধি খুঁজে বেড়িয়েছি, কি তীব্র মায়া ফেলে হারিয়ে গেলে...

চাইলে ফেরত দিয়ে দিতে পারো ফেলে যাওয়া মায়া..

এ কথা বললে এত্ত বছর পর!

কি বলবো পঁচিশ বছর পর? দুজনের পথ যেখানে দুদিকে
বেঁকে গেছে, বলে কয়ে কি আর সে পথ সমান্তরাল হবে?

দুজনেই চুপচাপ অনেকক্ষণ
কেউ কিছুই বলতে পারছে না।

আচ্ছা উঠি তাহলে আজ, সময় হয়ে এলো...

আমাদের আর দেখা হবে না অর্পা?

কিভাবে বলি...
আজ যে দেখা হবে, সেটাও কি জানতাম ?
ওই যে বললে না, স্রষ্টার খেলা..., ও আমিও বুঝি না।
উনি চাইলে দেখা হবে, না চাইলে না...
আমরা তার খেলার পুতুল, সময়ের সাথে বাঁকে এসেছি, সময় হলেফুরিয়ে যাবো। তবে আজ দেখা হয়ে অনেক ভালো লেগেছে, ভালো থেকো।

অর্পা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে ঘুরে দাঁড়ালো, তারপর দ্রুত হাঁটা শুরু করলো...দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা সে কিছুতেই রিহানকে দেখাতে চায় না।

রিহান অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছে অর্পার যাওয়া, যতক্ষণ যতদূর দুচোখে দেখা যায়....

এমআরএম/এমএস



Advertiser