মো. রওশন আলম পাপুল, গাইবান্ধা প্রতিনিধি: গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ। রংপুর বিভাগের ৫৮টি উপজেলার প্রবেশদ্বার এ উপজেলা। ১৭টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলা ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সম্প্রতি উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড নজর কেড়েছে সবার। মাত্র ছয় মাসে বাস্তবায়িত হয়েছে প্রায় অর্ধশত ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল উদ্যোগ। বড় ধরনের কোনো সহিংসতা ছাড়াই সর্বশেষ ইউনিয়ন পরিষদ সাধারণ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হওয়ায় জনমনে বেশ সন্তুষ্টি লক্ষ করা গেছে।
জানা গেছে, অর্থবছরকেন্দ্রিক পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করছে উপজেলা প্রশাসন। গত বছরের ১ জুলাই উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তারা মিলে নতুন অর্থবছরকে স্বাগত জানিয়ে একটি বিশেষ সভার আয়োজন করেন। নতুন উদ্যমে ও নতুন প্রত্যয়ে কাজ করার লক্ষ্যে নতুন অর্থবছরে বিভিন্ন পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়।
উপজেলা পরিষদ চত্বর ও বিভিন্ন দপ্তর ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৫০টি ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম বিআরডিবির ডিসপ্লে সেন্টার। বিআরডিবি অফিস থেকে এমব্রয়ডারি, ব্লকবাটিক, সেলাই ও শতরঞ্জিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মহিলাদের তৈরি করা পণ্য বিক্রির জন্য এ ডিসপ্লে সেন্টার তৈরি করা হয়েছে। উপজেলা পল্লী উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, প্রশিক্ষণের পর ঋণ দেয়া হয়েছে এমন প্রায় দেড় হাজার মহিলার কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্যে উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাঈদ এ উদ্যোগ নিয়েছেন। উপজেলা পর্যায়ে এ ধরনের ডিসপ্লে সেন্টার দেশের কোথাও আছে কি না সন্দেহ। গ্রামীণ পর্যায়ে মহিলাদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে এটি মাইলফলক হয়ে থাকবে বলে আশা করছেন তিনি।
বাস্তবায়িত উদ্যোগগুলোর মধ্যে পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা, সেবাগ্রহীতাদের জন্য গোলঘর স্বপ্নীল ও নান্দনিক টেনিস কোর্টও বেশ নজর কেড়েছে সবার। উদ্যোগ গ্রহণের ছয় মাসের মধ্যে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমির অস্থায়ী কার্যালয়, অফিসার্স ক্লাব টেনিস ইউনিট ও অফিসার্স ক্লাব পাঠাগার তৈরিও উল্লেখযোগ্য। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিবেটিং ক্লাব ও ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবও বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
জানা গেছে, গত বছরের ৩ অক্টোবর একযোগে উপজেলার ৩৭৩টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা অভিযান শুরু হয়, যার মাধ্যমে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যায় থেকে শুরু করে কলেজের শিক্ষার্থীরাও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও নিজের কাজ নিজে করার শিক্ষা লাভ করছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়- এই তিন ক্যাটাগরিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় তিনটি করে প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার দেয়ার সিদ্ধান্তও হয়েছে। এছাড়া, ২৭০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ফোন নম্বর ও হেল্পলাইনগুলোর তালিকাও দৃশ্যমান স্থানে টাঙানো হয়েছে।
গোবিন্দগঞ্জ বিএম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চালু করা হয়েছে অসুস্থতাকালীন মেয়েদের জন্য বিশ্রামাগার ‘ক্ষণিক’। সেখানে অ্যাটাস্টড টয়লেটসহ বেড, সোফা ও বইপুস্তকসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসামগ্রীর জন্য র্যাকের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সম্প্রতি শীতবস্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রেও সবার নজর কাড়ে উপজেলা প্রশাসন। সাধারণত শীতবস্ত্র বলতে কম্বল বিতরণ করা হয়ে থাকলেও এবার কিশোর-কিশোরীদের জন্য সোয়েটার ও কর্মজীবী দরিদ্র মানুষের জন্য গায়ের চাদরও বিতরণ করা হয়েছে। উপজেলার বাসিন্দা মো. আব্দুস সালাম বলেন, আমাদের জীবদ্দশায় কখনো সোয়েটার বা গায়ের চাদর বিতরণ করতে দেখিনি। এর আগে গত জুলাই মাসে ত্রাণ বিতরণে আগত দু:স্থ মানুষদের জন্য চেয়ারে বসার ব্যবস্থা করা হয়, যা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। কারণ, সাধারণত ত্রাণ নিতে আসা ব্যক্তিদের মাটিতেই বসতে দেয়া হয়। কিন্তু চেয়ারের ব্যবস্থা করাতে সবাই বেশ সম্মানিত বোধ করেছে।
এছাড়া, বিভিন্ন দপ্তরও বেশ কয়েকটি উদ্যোগ বাস্তবায়িত করেছে, যাতে উপজেলা প্রশাসনের সুসমন্বয় ও সুপরিকল্পনা ফুটে উঠেছে। উপজেলা ভূমি অফিসে পাঁচটি, উপজেলা মতস্য অফিসে সাতটি, উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে আটটি, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসে ১০টি এবং উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের অফিস, পরিসংখ্যান অফিস ও সমাজসেবা অফিসে দুইটি করে উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাঈদ বলেন, সবাই সমন্বিতভাবে কাজ করার কারণেই মাত্র ছয় মাসে প্রায় অর্ধশত ব্যতিক্রমী ও সৃজনশীল উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়েছে। উদ্যোগগুলোর বেশিরভাগই ক্ষুদ্র। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেকগুলো উদ্যোগ একসাথে করলেই সেটি বৃহত হয়ে দেখা দেয়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সাধারণত পহেলা জানুয়ারি বা পহেলা বৈশাখ গুরুত্ব দিয়ে পালন করি। কিন্তু পহেলা জুলাই আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। অন্ততপক্ষে নতুন উদ্যমে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে তো আমরা সেটি স্মরণীয় করে রাখতে পারি! কাজ করার ক্ষেত্রে সদিচ্ছাই যথেষ্ট।
সম্প্রতি ইউনিয়ন পরিষদ সাধারণ নির্বাচনে আটজন রিটার্নিং অফিসারকে নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করে উপজেলা প্রশাসন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, থানার অফিসার ইনচার্জ ও রিটার্নিং কর্মকর্তারা একসাথে ইউনিয়ন পর্যায়ে গিয়ে প্রার্থীদের সবার সাথে মতবিনিময় করেন। গাইবান্ধা জেলার তিনটি উপজেলায় পাঁচজনের প্রাণহানি হলেও গোবিন্দগঞ্জে বড় কোনো সহিংসতা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবেই নির্বাচন হয়েছে, অথচ গোবিন্দগঞ্জ নিয়ে এই আশঙ্কাই বেশি করেছিলেন গাইবান্ধাবাসী।
উপজেলা নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক মো. মতিন মোল্লা বলেন, সুপরিকল্পনার সাথে সদিচ্ছাই যে বড় জিনিস, সেটাই প্রমাণ করেছেন আমাদের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সাঈদ। তার কর্মকালের ১০ মাসে যা হয়েছে, অনেকে কয়েক বছরেও তা করতে পারেনি। উপজেলার অবৈধ স্থাপনা অপসারণ করে বিআরডিবির ডিসপ্লে সেন্টার, পাবলিক লাইব্রেরি ও টেনিস কোর্ট নির্মাণ গোবিন্দগঞ্জের ইতিহাসে স্মরণীয় থাকবে। আর, এবারের মতো শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অতীতে কখনও গোবিন্দগঞ্জবাসী দেখেনি। সবই সম্ভব হয়েছে সুপরিকল্পনার কারণে।
The post একটি সুপরিকল্পিত উপজেলা প্রশাসন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ appeared first on গোবি খবর.